Friday, January 23, 2009

ছোটদি - ৩


আবারো অনেকদিন দেরী হয়ে গেল । আপনার এই ব্যস্ত সময়ের মাঝেও আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন দেখে খুবই ভাল লাগছিল। আপনাকে বলছিলাম আমার ছোটদির গল্প। স্কুল ফাইন্যালের আগ পর্যন্ত আমি বেশ লক্ষীছেলে ছিলাম। কখনো কিছুতে গড়বড় হতে নিলেই ছোটদির কাছে ঠিকই ধরা খেয়ে যেতাম। ওর কথা অমান্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। ওর শাসনে মিষ্টি একটা দিক ছিল। প্রথমে শুরু হত বৃষ্টির মত ঝাড়ি। আমি তখন গোবেচারার মত মুখ করে বসে থাকতাম অপেক্ষা করতাম এরপরের অংশের জন্য। কিছুক্ষণ পরে এসেই আমাকে শতেক রকম ভাবে আদর করে বোঝানো শুরু হত এক পর্যায়ে কেঁদেই দিত। তখন আমাকে কথা দিতে হত আর করব না। শাসনের প্রথম ধাপ থেকে এই অংশের কার্যকরীতা বেশি ছিল। পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার সেটা করতে নিলেই ওর মুখখানা চোখের সামনে ভাসত।
আমার বহির্জীবনের সব কান্ডকারখানা ওর কানে চলে আসত। তার কারণ অবশ্য আমার বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর দল। আমার খবর রাখার জন্যই কিনা তাদের সবার সাথে আমার ছোটদির বহুত খাতির। ওদের এই গুপ্তচরগিরির জন্য কিছু বলতে গেলেই ওদের স্বীকারোক্তি,” দিদির সাথে মিথ্যা বলব নাকি, তোর চেয়ে দিদির কাছে সত্য বলে আদর পাওয়াটা ঢের বেশি ভাল” আর সাথে জুটত উপদেশ কেন দিদির কথা শুনিনা। সকল অপকর্মের সাথীরা যদি এরকম বলে তাহলে কেমন লাগে বলেন। ওদের বলতাম তোরা করিস কেন। আমার প্রশ্নে অবাক হয়ে ওরা বলত ” আমাদের কি ওইরকম দিদি আছে নাকি চিন্তা করার জন্য”।
আমাকে শিক্ষা দেওয়ার উপায়গুলাও ছিল অন্যরকম। স্কুল ফাইন্যালের আগে একবার বন্ধুরা মিলে প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। সিনেমা শেষ করে ফুরফুরে মেজাজা বাসায় ঢুকতেই মেঝদির সাবধানবাণী, ” তোর আজ খবর আছেরে খোকন, প্রাইভেট ফাঁকি দিয়েছিস খবর পেয়ে গেছে ছোট, দেখ কি হয় আজ”। ভয়ে ভয়ে ওর রুমে ঢুকে দেখি সেজেগুজে বসে আছে ও যেন এখনই বের হবে। আমাকে বলল চল বের হবি আমার সাথে। কোথায় যাব জিজ্ঞেস না করেই বের হলাম ওর সাথে। রিক্সা ঠিক করার আগে বলল কোন সিনেমা দেখেছিস বল আমিও দেখব তোর সাথে। আমার তখন মাথায় হাত। বন্ধুদের সাথে দেখা সিনেমা এখন দিদির সাথে কিভাবে দেখি। বার বার বলছি দিদি আর কখনো দেখব না কিন্তু ও কথাই শুনল না। আমাকে নিয়ে রওনা দিল সিনেমা দেখার উদ্দেশ্যে। আর সারা রাস্তা আমি লজ্জায় ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এরপর দিদি শুরু করল আমাকে বোঝানো। যে কাজ করে লজ্জা লাগে সেটা না করাই কি ভাল না? ওকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর কখনো ওকে না বলে কিছু করব না। সেদিন অবশ্য সিনেমা আমরা ভাই বোন দেখেছিলাম তবে সেটা না। ওই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কোথায় যেন সিনেমা সপ্তাহ চলছিল সেখানে। সেদিন “চিলড্রেন অব হ্যাভেন ” দেখে আমরা ভাই বোন কেঁদে বুকভাসিয়ে দিয়েছিলাম। ফেরার পথে ওকে বলেছি ছোটদি তোকে আমি এর চেয়েও অনেক ভালবাসি। তোর কথা কোনদিন অমান্য করব না দেখিস। দিদি শুধু আমার চুল এলোমেলো করে দিয়েছিল একটুখানি। ওকে দেওয়া প্রতিজ্ঞাটুকু অনেকবারই ভেংগেছি জীবনে তবে প্রতিবারই ওর মায়াবী মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আর অপরাধবোধে ভুগেছি।
ততদিনে আপনার সাথে আমার দিদির পরিচয় হয়ে গিয়েছে। ওর চোখেমুখে তখন অন্যরকম আনন্দের আভা দেখতাম।আমি আমার দিদির খুব কাছের বন্ধুও ছিলাম তাই প্রথম দিন থেকেই আপনার কথা ও আমাকে বলেছিল। প্রথম দিন কি বলেছিল জানেন? বলল আজ একটা হ্যংলা ছেলের সাথে দেখা হল । এইটুকুই। এরপর যখন আর্ট গ্যালারীতে আপনার সাথে দেখা হল হঠাৎ করে সেদিন ও উত্তেজনায় টগবগ করছিল। সেদিন ওকে বলেছিলাম তুই বুঝি ঐ হ্যাংলার প্রেমে পড়লি। লজ্জায় রাঙা হয়ে আমার দিদি আমার সাথে পরামর্শ করছিল আপনাকে ফোন করা ঠিক হবে কিনা কিভাবে আপনাকে চাইবে। আমার খুব ভাল লাগছিল কিন্তু কোথায় একটু বুঝি ঈর্ষাও হচ্ছিল। কপট রাগের ভান করে বললাম আমি কিন্তু jealous হয়ে যাচ্ছি। প্রেমে পড়ে আমাকে আদর করার কথা ভুলে যে যাবা খুব ভালই বুঝতে পারছি। আমি এইসব বলতাম যাতে দিদি আমাকে বেশি করে আদর করে। সেটা সেও বুঝত। তাই তো আদর করে বলত তুই আমার পিচ্চিসোনা, আজীবন তোর আদর ঠিক থাকবে।
“তোমার নিজের যখন পিচ্চি হবে তখন?” আবার জিজ্ঞেস করি আমি। হেসে উঠে বলেছিল ” দেখিস কখনোই কম পড়বে না”।
একদিন ক্লাসের এক ছেলে এসে আমাকে বলল “তোর দিদিকে দেখলাম ময়দানের ওদিকে একটা লোকের সাথে। সেটা কি ওনার বয়ফ্রেন্ড?” । প্রশ্নে কি যেন একটা ছিল আমার প্রচন্ড রাগ হল। বিশু না ঠেকালে সেদিন ওকে আচ্ছামত পিটাতাম। বাসায় ফেরার সময় একটা শব্দই মাথায় ঘুরছিল “বয়ফ্রেন্ড”। খুব বিশ্রী লাগছিল শব্দটা। বাসায় এসে দিদির সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করলাম। রাতে ঘুমাবার সময় ও আসল আমার মাথার পাশে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। একসময় জিজ্ঞেস করল, ” কি হয়েছে পিচ্চি? আমাকে বলবিনা?” সব খুলে বললাম ওকে, কেন যে আমার খারাপ লাগছিল সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না সেটাও বললাম। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দিদি আপনার গল্প করেছিল আমার কাছে। কি যে অসম্ভব ভালবাসত দিদি আপনাকে সেদিনই বুঝেছিলাম।

আমার স্কুল ফাইন্যালের সময় দিদি বাড়াবাড়ি পাগলামি শুরু করে দিয়েছিল। মাষ্টার্স শেষ করে দিদির তখন অঢেল সময়। কাজের মধ্যে হচ্ছে আমার পড়ালেখা, খাওয়াদাওয়ার তদারকী করা। একটু রাত হলেই এসে জোর করে বিছানায় শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত পাছে রাত জেগে শরীর খারাপ করে আর প্রতি খাবার বেলায় হাজারটা বাড়াবাড়ি। প্রতিটা পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখতাম আমার দিদি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে খাবার নিয়ে। বন্ধুবান্ধবরা সবাই নিজেদের তখন অনেক বড় মনে করতাম। কারো জন্যই কেউ আসত না। সবাই যখন কে কেমন পরীক্ষা দিল কার পাশে কোন মেয়ে কি জামা পড়ে আসল দেখতে কেমন , কেমন করে না পেরে ওকে জিজ্ঞেস করল এইসব নিয়ে আলোচনা করত আমি তখন দিদির হাতে ভাত খেয়ে পরের পরীক্ষার জন্য বই দেখছি। ছোটদির হাতে খাওয়ার জন্য বন্ধুরা পরে আমাকে টিটকারী দিবে এইসব বলে যদিও খেতে চাইতাম না কিন্তু মনে মনে যে ইচ্ছে করেই ওর হাতে খাওয়ার জন্য আমি বই খুলে পড়ার ভান করতাম সেটা কি ও বুঝত?
পরীক্ষা শেষ হবার দিন খুব মজা হয়েছিল। বন্ধুরা সবাই মিলে দিদিসহ আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিন দেখেছিলাম প্রিন্সেস ডায়েরী। দিদিই সবার জন্য টিকেট কেটে রেখেছিল আগে থেকেই। এরপর দিদি আমাদের ডিনার করিয়েছিল। খেতে খেতে বেশ আড্ডা হচ্ছিল। প্রদীপ বলল ” আপনি যখন পাশে থাকেন তখন খোকনটা আমাদের একদমই চিনেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার মত একটা দিদি আমার থাকলে খুব ভাল হত”। আমার মায়াবী দিদি তখন বলেছিল ” তোমরা সবাই তো আমার কাছে খোকনের মতই। ” আমি পাশ থেকে বলেছিলাম “ইশশ আমার দিদির ভাগ আমি কাউকে দিলে তো”। বিশু বলেছিল দিদি সত্যি আমার মনে হয় রানুদিকে বাদ দিয়ে আমিও তোমার ভাই হই কিন্তু খোকন এত স্বার্থপর ওর জন্য আর সাহস হয় না।
দিদি আমি আর স্বার্থপর হবনা। প্লিজ তুমি ফিরে আস প্লিজ…

No comments: