Friday, May 8, 2009

আয় আরেকটি বার আয়রে সখা, প্রাণের মাঝে (০১)

১।
কলেজের দ্বিতীয় দিনেই ফুটবল খেলতে গিয়ে নিজেকে জাহির করার তাগিদ অনুভব করলাম আমি। প্রথম দিনেই সবার দৃষ্টি কাড়তে হবে এমন একটা ভাব নিয়ে ২১-২১ জনে খেলা এ ফর্ম, বি ফর্ম খেলার মাঝেই আমি প্রচুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলাম। ২১ জনের মধ্যে আগের দিনের বৃষ্টিতে কাঁদামাখা সেই মাঠে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে তোলা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। সবার প্রথমে সবাই স্ট্রাইকার হতে চায়, দ্বিতীয়ত যেখানেই বল যায় সেখানেই সবাই হাজির হয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ঠিক তখনই ডি বক্সের সামনে উলটা অবস্থায় বল পেয়ে আমি এইটাকেই শেষ চান্স ভেবে ব্যাকভলি করার জন্য লাফ দিলাম। পায়ে বল লেগেছিল কিনা গোল হয়েছিল কিনা আজ আর মনে নেই। সেদিন গোল দিতে পেরেছি বলে মনে পড়ছে না কিন্তু ঠিকই সবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিনই আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল সকাল বেলা নিজের হাতকে আর হাত মনে হচ্ছিল না। সেই ব্যাকভলি দিয়ে হাত ফুলে গিয়েছিল। এরপর পাক্কা দেড় মাস হাসপাতালে ছিলাম হাতে প্লাস্টার নিয়ে। সবাই জানত ওদের একটা ক্লাসমেট আছে নাম ও মনে হয় জানত না যে কিনা হাসপাতালে থাকে। ২ সপ্তাহ পরে অবশ্য প্লাস্টার জড়ানো হাত নিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম। হাসপাতালে থাকার কারণে অনেকদিন পর্যন্ত আমি আমার হাউসের সবার নাম ও জানতাম না। নিজের ফর্মের পোলাপানদের চিনতাম শুধু। তাই আমার সাথে সবার চেনাজানা একটু দেরিতেই হয়েছিল।

হাসপাতালে থাকতেই জাহিদের সাথে পরিচয়। কোন একদিন ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল । কলেজের খাবার খেতে পারেনা। বেশ কয়েকবার বমি করেছে। হাসপাতালে আসাতে আমি পুরান রোগী হিসেবে ক্লাসমেটকে বরণ করলাম। কিন্তু সেখানে তেমন কিছু অন্তরঙ্গতা হল না। আমার আগেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেল। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব শুরু হল বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে। তখন আমাদের নভিসেস প্যারেড শেষ আমরাও কলেজের ক্যাডেট হয়ে গেছি। বাস্কেটবল নতুন খেলা দেখে আমরা বেশ কসরত করে সেটা শেখার চেষ্টা করি। তার মধ্যে আমি আর জাহিদ ও আছি। যারা আমাদের শেখায় তারাও খুব যে পারে তা না ওরা একটু লম্বা এই জন্যই বল নিয়ে কিসব করে দেখায় আমাদের। আমরা হা হয়ে তাকিয়ে থাকি। কখন থেকে যে আমরা একেবারে টিম হয়ে খেলা শুরু করে দিলাম মনে নেই। তবে জাহিদের সাথে আমার মনে পড়ে না আমি আর ও কোনদিন এক দলে ছিলাম। কেমন করে খেলতে খেলতে আমরা দুজনই একই পর্যায়ের খেলোয়াড় হয়ে গেলাম। যার কারণে দল ভাগ করার সময় প্রথমেই আমাদের দুজনকে দুদিকে দিয়ে দেওয়া হত। আমরাও সেই দুই দলের হয়ে প্রতিদিন খেলার মাঝে এবং আগে পরে গলা ফাটিয়ে নিজেদের মাঝে ঝগড়া করতাম। ক্লাস ৮ পর্যন্ত আমি আর জাহিদ প্রায়ই খেলার মাঝে একে অপরের সাথে লাগালাগি করেছি। সেই ঝগড়াই আমাদের কাছে এনে দিয়েছে। খেলা শেষে প্রতিদিন একসাথে আবার হাউসে ফিরতাম। পরেরদিন আবার ঝগড়া। একসময় দেখলাম আমরা শুধু খেলার সময়টুকুই আলাদা থাকি।
৩।
পরীক্ষার সময় ও আমাদের আগে পরে বসা নিয়ম হয়ে গেল। কেমন কেমন করে যেন ও আমার আগে পিছে কিংবা কোনাকোনি থাকতই। আর আমরা ২ জন এক সিট ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকলে আর কিছু লাগত না। ফর্মের মাঝে হয়েছে এমন খুব কম পরীক্ষাই ছিল যেটাতে আমাদের দুজনের অবজেক্টিভ এর মার্কস আলাদা আসত। তাই ওকে শুধু সাবজেকটিভ দিয়ে পিছনে ফেলতে খুবই কষ্ট হত। ওকে নিয়েই ভয় পেতাম এই বুঝি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিল আমার পজিশন থেকে। কিন্তু কি একটা অবহেলা ছিল ওর মাঝে। এমন ভাব আমি পারি কিন্তু করব না। কখনোই পড়ালেখায় সেইরকম সময় দেয়নি ও। এসএসসি পরীক্ষার পর আমাকে বলেছিল তুই ও ফার্স্ট হবার মত পড়িস নি আমিও না। তাই আফসোস নাই। সেদিন মনে মনে বলেছিলাম এবার পড়ব। কিন্তু ওর মনে হয় এইসব খুব একটা কিছু এসে যেত না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট এর পর আমরা অনেকেই যখন রাত জাগি, কেউ পড়ার ভান কেউ বা বই নিয়ে গার্ডদের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করে কাটাত কখন ডাব পাড়তে যাবে কিংবা সিগারেট খাবে তখন তার অর্ধেক ঘুম পার হয়ে গেছে। ওর রুমমেট অন্য রুমে গিয়ে সময় কাটাত যাতে ওর ঘুমের সমস্যা না হয়। আমাদের আরেক বন্ধুর আফসোসই ছিল যে হাউসের সবাইকে ডাব খাইয়েছি শুধু জাহিদ ছাড়া। তারপরও রেজাল্ট বের হবার পর দেখা গেল মেরিট লিস্টে খুব ভাল পজিশনে ও। আমি শুধু ভাবি ভাগ্যিস ও আমাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়নি কখনো।
৪।
কার্ড খেলতাম আমরা খুব। সেই ক্লাস ১১ থেকে ২৯ খেলতাম পাগলের মত। ছুটিতে এসে কত রাত যে পার করে দিয়েছি শুধু কার্ড খেলে তার গুনতি নেই। বুয়েটে ঢুকেও ডেল ক্যাফেতে বসে বসে শুধু কার্ডই খেলতাম ( আমাদের জন্যই কিনা ডেল ক্যাফে পরে বন্ধ করে দিল কোন অনুষ্ঠান ছাড়া ঢোকা যেত না। এখন কি অবস্থা কে জানে) । বুয়েটে এসে আমাদের উন্নতি হল আমরা ব্রিজ খেলা শিখলাম। কত ক্লাস যে বাং মেরেছি কার্ড খেলার জন্য। জাহিদের কার্ড খেলার স্টাইল যেই ওর সাথে খেলেছে মনে থাকবে নিশ্চয়ই। এমন ভাব ধরত যেন সমস্ত ভাল কার্ড ওর কাছেই। এমন ভাবে কল দিত যেন তোলা কোন ব্যাপারই না। খেলা হারার পর ও এমন ভাব মনে হত ওর মন ছিল না খেলায় নইলে ওকে হারাতে পারে এমন কেউ আছে নাকি। গুড প্লেয়ার আর ভাল খেলোয়াড় এই দুইটার একটা পার্থক্য ছিল আমাদের মাঝে। যে ভাল কার্ড পায় তারপর খেলা তুলে সে গুড প্লেয়ার আর যে কিছু না পেয়েও মাথা খাটিয়ে খেলে সে খেলা তুলতে না পারলেও ভাল খেলোয়াড়। নিজেকে ভাল খেলোয়াড় দাবি করে আসল জাহিদ আজীবন। ওর সাথে কার্ড খেলা খুবই মিস করি। এখন আর খেলে না ও। সেদিন প্রায় ৫ বছর পর এক রাত ওর সাথে কার্ড খেললাম। জীবনেও ভাবি নাই আর কখনো জাহিদের সাথে কার্ড খেলব।
৫।
৯৬ থেকে ২০০৯ আজ ১৩ বছর আমি আর জাহিদ একসাথে। কলেজ থেকে বের হয়ে একসাথে বুয়েট কোচিং করে বুয়েটে একসাথে প্রতিটা দিন আড্ডা দিয়ে একইসাথে জাপানে পাড়ি দিয়েছি আমরা। মাঝে ৩ বছর দুজন দুইটা ইন্সটিটিউশনে ছিলাম এখন আবার একসাথে। আমার পাশের বিল্ডিং এই থাকে (অবশ্য বউ নিয়ে … ) । বন্ধু হিসেবে জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি ওর সাথে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাব প্রকাশে এখন মনে হয় আর আমাদের কথা বলার ও দরকার হয় না। এই লম্বা সময়ে যে ওর সাথে রাগ করিনাই এমন না। অনেক বার ওর অনেক কাজে ক্ষেপে গিয়েছি ভেবেছি আর কখনো কথাই বলব না, কখনো বা ভেবেছি শালা মজাতেই আছে অনেক বদলে গেছে আমার আর এখন দরকার নেই কিন্তু কেমন করে যেন আবার ঠিক হয়ে গেছে তা আর মনে নেই। মনে আছে সর্বোচ্চ এক মাস ওর সাথে কথা না বলে থেকেছিলাম কলেজে ক্লাস ৯ এ থাকার সময়। কেন লেগেছিলাম তাও মনে আছে কিন্তু এখানে লেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এত ছেলেমানুষ ছিলাম সেটা আমার আর ওর মাঝেই থাক। ১৩ বছর অল্প সময় না। তাই আজ বন্ধুদের নিয়ে কিছু লেখতে গিয়ে ওর নামই প্রথমে মনে পড়ল।
ভাল থাকিস দোস্ত।