Wednesday, March 18, 2009

আমার কাজলাদিদিরা -শেষ পর্ব (আপুসোনা)

এইচ,এস,সি পরীক্ষার আগের শেষ ছুটিতে কলেজ থেকে ঢাকা আসলাম। রাত জেগে পড়ালেখা করি আর দিনের অর্ধেকটা সময় ঘুমাই। রাতের ১০টা না বাজলে আমি পড়া শুরু করতে পারি না।কোন স্যারের কাছে পড়তাম না বলে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে হলে মাঝে মাঝে বিকেলে যেতাম কোথাও। সেখানেই শুনলাম ওমেকায় নাকি এক ভাইয়া আছে আলী ভাই (পিসিসি) অসাধারণ কেমিষ্ট্রি পড়ায়। বাকি সব বিষয় নিজে নিজে সাইজ করে ফেললেও কেমিষ্ট্রি বিশেষ করে ২য় পত্র তখনো খালি মুখস্ত আর ভুলে যাওয়ার বৃত্তেই ছিলাম। ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি। পোলাপান বলল ওমেকায় নাকি ক্যাডেটদের জন্য একটা প্রিপ্যারেশন ক্লাস হচ্ছে বহুত কলেজের পোলাপান আসে। মর্তুজার সাথে গেলাম ওমেকায়। প্রথম দেখেই মিজান ভাই এমন গড়গড় করে আমার নাম ঠিকানা বলতে লাগল ভাবলাম কি ব্যাপার আমার সাথে তো এনার এর আগে দেখা হয়নি। যাই হোক উনি বলল উপরে চলে যা একটা ফিজিক্স ক্লাস হচ্ছে তারপর আলী ক্লাস নিবে। কোথায় ওয়েট করব খুঁজে না পেয়ে ক্লাসেই ঢুকলাম। দেখলাম চশমা পড়া একটা আপু ক্লাস নিচ্ছে। ক্লাসে ঢুকে অসংখ্য ক্যাডেটের সাথে হাই হ্যালো করাটাই প্রধান কাজ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই আপুটা আমাদের চুপ করতে বলল। প্রথমবারের মত ওনার দিকে তাকালাম। ওর কথা খুব সুন্দর। কিছুক্ষণ কথা শুনে আমরা সবাই তার ভক্ত হয়ে গেলাম। ক্লাস শেষে সবাই আপু কি করে কোথায় পড়ে সেই খবর নিচ্ছিল। সেদিন বাসায় ফিরে ওর নামটা আর আমার মনে থাকল না কিন্তু সেই চেহারা মাথার ভিতর থেকে গেল। আমার মনে হচ্ছিল এত মায়াবী চেহারা আমি আর দেখিনি। সেদিন থেকে আমি সবসময় আমার কল্পনার বোনটার একটা চেহারা বানিয়ে নিলাম। সেটা হুবহু ওর মতই দেখতে। এরপর কলেজে গেলাম ইন্টার পরীক্ষা দিলাম রেজাল্ট হল ওমেকায় ভর্তি কোচিং করলাম আর কোনদিন ওর সাথে দেখা হয়নি। পরে শুনেছি সেদিনই ওর প্রথম এবং শেষ কোচিং এ ক্লাস নেওয়া ছিল। আমি ওর নাম ভুলে যেতাম বন্ধুদের বলতাম ওই আপুটার কি জানি নাম ছিল?
ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সেই মায়াবী আপুটা যেই ভার্সিটিতে পড়ে সেখানে চান্স পেলাম। মাঝে মাঝে দেখা হয় কিন্তু পরিচয় নেই তাই কথা বলি না। আমার বন্ধুদের দুএকজনের সাথে দেখি আপুর হাই হ্যালো চলে। আমিও পাশে থাকি একটু হয়ত হাসি দেয় , আর আমি সবসময় ভাবি আপুর সাথে পরিচয় করতেই হবে। এক বছরের মাথাতে জাপান চলে আসলাম। আর কখনো ওর সাথে দেখা বা যোগাযোগ হওয়ার কথা না। প্রথম যখন দেশে গিয়েছিলাম সেবার জ়ে এম বি সারা দেশে যেদিন বোমা মেরেছিল বুয়েটে সেদিন ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম আপু ভাল আছেন? মনে হয় সরাসরি সেটাই আপুর সাথে আমার প্রথম কথা। ২০০৬ সালের এপ্রিল এ ছুটি কাটাচ্ছিলাম হঠাৎ কি মনে হতে অরকুটে আপুর একটা ছবি দেখে আপুকে একটা মেসেজ দিলাম। এরপর ভুলে গেলাম। কিছুদিন যেতেই দেখি সেখানে আপুর ফিরতি কমেন্ট, "তোমাকে মেইল করেছিলাম পাওনি" । আমি তো অবাক হয়ে গেলাম আমাকে মেইল করল কখন। হটমেইলের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে স্প্যাম ফোল্ডারে গিয়ে আপুর মেইল পেলাম। এরপর আপুকে মেসেঞ্জারে এড করলাম । আমার তখন ছুটি চলছে আর আপুর ও তখন মনে হয় কিছু একটা নিয়ে ক্লাস বন্ধ। প্রথম যেদিন কথা হয়েছিল আমার মনে আছে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম ও কি সুন্দর আদর করে কথা বলে। যখন ভাইয়া বলে ডাকে তখন মনে হয় আমি আসলেই ওর আপন ভাই। কত আগে থেকে ওকে আমি আপু হিসেবে ভাবা শুরু করেছিলাম সেই তার থেকে এমন ফিডব্যাক পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা । সেদিন কোন কারণে ওর মন খারাপ ছিল। ওকে বললাম আপু চিন্তা করবেন না আপনার মন ভাল করে দিব। পরের দিন ক্লাসে বসে ওকে একটা চিঠি লিখলাম। পোষ্ট করলে পাবে দেরিতে তাই স্ক্যান করে মেইলের সাথে এটাচ করে পাঠিয়ে দিলাম। হাতে লেখা চিঠি দেখে ও অসম্ভব খুশি হল। আমাকে বলল তোর মত আমার যদি একটা ছোট ভাই থাকত। এই কথা শোনার জন্য সেই ছোটবেলা থেকে আমি অপেক্ষা করেছি। এই প্রথম কেউ আমাকে ভাই বানাতে চাইল।
আপুর সাথে আমার প্রতিদিন কথা বলা শুরু হল। ও আমাকে পিচ্চি বলে ডাকে। আর আমি মনের আনন্দে সারাদিন আপু আপু করতে থাকি। কথায় কথায় ওর সাথে আমার সম্পর্ক এরকম হয়ে গেল আমার আর মনেই হয় না আমার কখনো বোন ছিল না। সবাইকে বলে বেড়াই আমার বোন আছে। আপনি থেকে কখন যে ও তুমি হয়ে তুই হয়ে গেল নিজেই টের পেলাম না। নেটে এসে বসে থাকতাম কখন আমার আপুটা আসবে। ও নেটে এসে আমাকে না দেখলেই মোবাইলে মেসেজ দিত ," পিচ্চিসোনা তুই কোথায়? আপুর সাথে কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়েছিস?" আমি যেখানেই থাকি না কেন ঘুমে হলেও সেই মেসেজ পেয়ে নেটে এসে বসি। ভাই বোন রাজ্যের অকাজের কথা বলি। এরপর হঠাৎ করে ওর খেয়াল হয় আমার অনেক রাত হয়ে গেছে। ঝাড়ি মেরে আমাকে ঘুমাতে পাঠাত । যেদিন রান্না করতাম না সেদিন গিটার স্ম্যাশ করত আমার মাথায়। ওর ঝাড়েই খেয়ে যে কতদিন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও রান্না করেছি। আগে না খেয়েই কাটিয়ে দিতাম কত দিন, ওর মায়াবী শাসনে সেসব বন্ধ হল। রাতে যেদিন হঠাৎ করে ঘুম আসতে চাইত না তখন ওর মোবাইলে মেসেজ দিতাম আপুমনি, ঘুম আসছে না আমার। ও মেসেজ দিত , " তুই চোখ বন্ধ কর আপু তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুম এসে পড়বে"। সত্যি সত্যি যেন ওর হাতের স্পর্শ পেতাম। দিনে দিনে ওর সাথে থাকতে থাকতে আমি নিজেকে আরো ছোট ভাবতে লাগলাম। মনে হত আমি বুঝি ৪-৫ এ পড়া পিচ্চি আর ও আমার জানের জান আপুসোনা। ও আমাকে বলত , " পিচ্চি আমি যখন কাউকে ভালবাসি তখন একেবারে এত্ত ভালবাসি দেখিস আবার তুই বিরক্ত হয়ে যাইস না"। আমি মনে মনে বলি আপু আমি আজীবন এরকম আদরই চেয়েছি রে। ওকে আমি কত্ত নামে ডাকা শুরু করলাম। কখনো আপু, কখনো আপুমনি, কখনো আপুনি, কখনো আপ্পি। তবে ও ছিল আমার আপুসোনা। এত ভাবে ডেকেও আমি নিজের ভাব কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। চিঠি লিখে ওর কাছে আসা এই জন্য মনে হয় ইচ্ছা হলেই আমি ওকে চিঠি লেখতাম। হয়ত একটা বোরিং ক্লাস হচ্ছে আমি হঠাৎ এক পেজ নিয়ে লেখা শুরু করে দিতাম।

একদিন পরীক্ষা চলছিল তখন আমার, পরীক্ষা দিয়ে এসে ঘুমিয়েছি দুপুরে আগের রাত জাগার কারণে হেভভি ঘুম যখন আসল তখনই অফিস থেকে আমাকে ডাকল কি নাকি রেজিষ্ট্রি করা জিনিস এসেছে। মেজাজ খারাপ করে গেলাম কিন্তু তখনো বুঝিনি আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। গিয়ে দেখি একটা বিদেশি খাম প্রাপকের জায়গায় আমার নাম। আর বাম দিকে একটা অসম্ভব প্রিয় নাম। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এর আগে অনেককেই অনেক ভাবে আমি সারপ্রাইজ দেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি এই চিঠি পেয়ে বুঝতে পারলাম আসল সারপ্রাইজ কি জিনিস। খুব ছোট্ট একটা চিঠি কিন্তু কতবার যে সেটা আমি পড়েছি। দিনে দিনে রকেটের গতিতে আমার আপুসোনা আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল। এমন কোন দিন নেই যে ওকে আমার মনে পড়ত না। আর প্রতিদিন রাতে তো কথা হতই। সারাদিন অপেক্ষা করতাম ওর নেটে আসার জন্য। বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য ওর পরীক্ষা তখন পিছিয়ে গেছে। আমার থেকে খুশি আর কে তখন। বাসায় আমার আম্মু, ভাই সবার তখন আমার মুখে ওর নাম শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গেছে। আমি সবাইকে বলে বেড়াই পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবতী মেয়েটি আমার বোন। এর পর দেশে গিয়েছিলাম দুমাস পরে। প্লেন থেকে নেমেই আমার আপুসোনার ফোন আসল। এরপর প্রতিদিন রাতে ও আমাকে ফোন করত। ওর সাথে প্রথম যেদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম সেদিন বড় আপুর জন্মদিন ছিল। আপু আমাকে লাঞ্চ করাল। প্রথম দেখলাম আমার আপুসোনাকে, প্রথম ওর কাছাকাছি গেলাম। মনেই হল না যে ওকে আমি চিনেছি মাত্র কিছুদিন আগে। ওর ফ্যামিলির সবাই আমাকে ওর ছোট ভাই হিসেবেই নিল। আপু হয়ে গেল আম্র বড় আপু আর ওনার হাজব্যান্ড আমার ও ভাই। ওদের ফ্যামিলির সাথে আশুলিয়ায় একটা ডিনার করতে গিয়েছিলাম আমি সামনের সিটে বসে আছি হঠাৎ আপু পিছন থেকে আমার চুল এলোমেলো করে দিল। অসম্ভব ভাল লাগায় চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিল। ওর আদর পেয়ে আমার তখন মনে হচ্ছিল আমার আপন বোন থাকলেও বুঝি এইরকম আদর করতে পারত না। ছোট বেলা থেকে বোন না থাকার কারণে বিধাতার কাছে যে অভিমানটুকু আমার ছিল সব চলে গেল ওকে পেয়ে।
বন্ধুবান্ধবের বহুত পচানো খেয়েছি ওকে নিয়ে অনেকে অনেক রকম টিটকারী করত। মেজাজ খারাপ হত, আপুকে বলতাম। বলতাম আপু তুই কেন আমার আপন আপু হইলি না তাহলে তো ওরা এরকম করত না। আপু বলত, " তুই আমার ভাই এটা আমরা জানলেই হবে বাইরের মানুষ কি ভাবল সেটা আমলে নিস না।" দেশ থেকে ফিরে বাসার জন্য দেশের জন্য যখন অসম্ভব মন খারাপ তখন আপুও ছিল না দেশে। ইন্ডিয়ায় ছিল ও। ও দেশে ফিরে এসেই আমাকে একটা মেসেজ পাঠাল, " বাবুয়া, তোকে আমি এখন থেকে বাবুয়া ডাকব। দেশে ফিরে তুই নাই দেখে এত্ত খারাপ লাগছে আমার মনটা হুহু করছে তোর জন্য, যদিও দেখা হত না কিন্তু তাও মনে হত দেশেই তো আছিস। আন্টি কিভাবে তোকে ছেড়ে থাকে?"
এই মেসেজ পড়ে আমার চোখে পানি চলে আসল। আমার আপুসোনাটা সত্যি পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী মেয়ে। আবার শুরু হল আপুর সাথে আমার নেট কথোপকথন। আমার একাকী জীবনে ও ছিল বদ্ধ ঘরের মাঝে একমাত্র জানালার মত। আমার খারাপ লাগা, ভাল লাগা, একা লাগা, সব কথা আমি ওর কাছে বলতাম। কখনো ভাবিনি ও বিরক্ত হবে। এ ছিল আমার দাবীর মত। আমি ওর ছোটভাই ওকে বিরক্ত করতে পারাটাও আমার অধিকার ভাবতাম। তাই মন খারাপ হলেই ওকে ডাক দিতাম আপুসোন একটু ক্ষনের জন্য হলেও আয় একবার নেটে। আমার কোন চাওয়াই অপূর্ণ থাকত না। না আসতে পারলেও আদর করে এমন একটা এসএমএস দিত সেটাতেই আমার মনটা ভরে যেত। আমার মা আমাকে সাবধান করে দিত। দেখ তপু এত আপু আপু করিস না পরে কষ্ট পাবি। আমি মানতেই চাইতাম না এ যে আমার আপুসোনা। আরেক জন্মে আমরা যে আসলেই ভাই বোন ছিলাম। ওকে বলতাম আপুসোন তুই আমার টুইন বোন হ। টুইন জিনিসটা আমার খুবই কিউট লাগে। এখন লিখতে গিয়ে কত ছোটখাট মজার কথা মনে পড়ছে তাই লেখা অনেক আস্তে আগাচ্ছে। হঠাৎ করে ছন্দপতন হল। আমার আপুসোনা ওর পার্সোনাল জীবনে এলোমেলো হয়ে গেল। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম তখন আপুর পাশে থেকে আপুর মন ভাল করার জন্য। কিন্তু ছোটভাইর সাথে শেয়ার করাটা একসময় আর ওর ভাল লাগল না। বড় বেশি জটিল হয়ে গেল আমার সবসময়ের হাসিখুশি আপুসোনাটার জীবন। আমি আমার আপুসোনার কাছে আর থাকতে পারলাম না। নেটে এসে আমাকে আর ডাকে না। আমি থাকলেও কথা বার্তা বলে না তেমন একটা। আমি এপাশ থেকে বকবক করতে করতে হঠাৎ টের পাই ও আমার কথা শুনছে না। তীব্র অভিমান হল আমার। কদিন আমিও সরে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ততদিনে আপুকে ছাড়া আমার চলে না। আবার এসে ওকে নক করি, ন্যাগ করি। আপুও বিরক্ত হতে থাকে কিন্তু আমার তখন বুঝেও কিছু করার নেই। একদিন ওকে অভিমান নিয়ে সব কথা বলেই ফেললাম কেন আপু এখন আর আমাকে আগের মত আদর করে না। ও স্যরি হল বলল পিচ্চি তোর আপুসোনাটা অনেক খারাপ শুধু নিজের জীবন নিয়েই চিন্তা করে তোর কথা ভুলে গিয়েছিল। ওর আদর মাখা কথা গুলা শুনে আমি আবার ঠিক হয়ে গেলাম। আপুকে বললাম আপু তুমি প্লিজ আবার আগের মত হয়ে যাও। কিন্তু আমি তখন বুঝিনি যা একবার চেঞ্জ হওয়া শুরু করে তা আর কখনো আগের মত হয়ে ফিরে আসে না। এরপর ও আপুর সাথে আমার কথা বার্তা হত। হঠাৎ করে অনেকদিন আপুকে নেটে দেখলাম না। ওর সাথে কথা না বললে আমার তখন পেটের ভাত হজম হয় না টাইপ। কিন্তু ও তখন নিজের ঝামেলা নিয়ে এত ব্যস্ত আমার দিকে তাকাবার ফুরসত নেই ওর। আমার ছেলেমানুষী কথাবার্তা শোনার সময় দিতে ওর বিরক্ত লাগল। অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি তাও প্রতিদিন ওর জন্য নেটে বসে থাকি আর ঘুমাবার আগে ওকে মেইল করে শুতে যাই। সারাদিন মোবাইলে তাকিয়ে থাকি এই বুঝি আমার আপুসোনার একটা মেসেজ আসবে আমার মোবাইলে লেখা থাকবে পিচ্চিসোনা তুই কি আপুর উপর রাগ করেছিস? কত্ত দিন তোর সাথে আড্ডা দেওয়া হয় না। যেই আপু আগে আমাকে বলত , ” বাবুয়া তুই সবসময় হাসিখুশি থাকবি তোর হাসিমুখ না দেখলে বড় অস্বস্তি লাগে” সেই আপু এখন আমার খবর নেয় না। নিজেকে আমি বুঝাই আমার আপুসোনার এখন ক্রিটিক্যাল সময় যাচ্ছে। এটা কেটে গেলেই আবার আমার আপুসোনা আগের মত হয়ে যাবে। এ হল বড় হবার যন্ত্রণা। তখন মনে হত কেন আরো ১০ বছর আগে আমি আমার এই আপুসোনাকে কাছে পেলাম না। ও নানা সময়ে এমন অনেক কাজ করেছে যেটা স্পষ্টতঃ আমাকে বোঝানো যে আমি ওকে বিরক্ত করছি, আমার হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য ও অনেক সময় মিথ্যা কথাও বলত। আমি সবই বুঝতাম কিন্তু সরতে পারছিলাম না। বোনটাকে হারিয়ে ফেলব এ জিনিস আমি যে কখন ভাবিনি। আমার মা আমাকে বোঝাত, তুই তো ওর আপন বোন না ও কেন তোর জন্য এত করবে, তোর জন্য নিজের ঝামেলা বাড়াবে। আমি সব শুনি আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি, ” এভাবে ঝেড়ে ফেলবিই যদি তাহলে কেন এত আদর করেছিলি”। তুইই তো বলেছিলি যে খুব বেশি ভালবাসবি আমাকে আমি যেন বিরক্ত না হই। এখন কেন আমার ভালবাসা তোর কাছে বিরক্ত লাগে। এখন কেন তোর মনে হয় আমার এক্সপেক্টশন বেশি, আমি অবুঝ । আমাকে পিচ্চি বানিয়েই তো তুই আদর করতি। আমার তো বুঝার কথা না। আমি তো তোর পিচ্চিসোনা , বাবুয়া ছিলাম।
কত বার ভেবেছি আর কখনো ওর কাছে যাব না। ওকে নিয়ে ভাবব না। কিন্তু তা কি আর পারা যায়। মাঝে মাঝে কষ্টে ভাবতাম আমার মত কষ্ট আপু তুইও পাবি। সাথে সাথে ভাবতাম এ কি বলি আমি। আমার আপুসোনা কেন কষ্ট পাবে। ও সুখে থাকুক সারাজীবন। ওর জীবনের সব কষ্ট যদি আমি ভোগ করে দেই তারপর যদি ওর আর কখনো হাসি মুখ মলিন না হয় তাহলে আমি রাজি। একটা সময় আরো কিছু ঘটনা ঘটাতে সহ্য করতে না পেরে আমি হাল ছাড়লাম। ওর থেকে সরে আসলাম। বন্ধ করলাম ওকে মেইল করা। ততদিনে ওর সাথে আমার যোগাযোগ একেবারে শূন্যের কোঠায়। আমি মেইল করলেও ও তখন আর উত্তর দেয় না। সব ছেড়ে আমি তখন আমার আপুসোনার সাথে কাটানো ৭ মাসের স্মৃতি ঘাটি। পুরান মেইল পড়ে নতুন করে আদর অনুভব করার চেষ্টা করি। আমার মা আমাকে অনেকভাবে বুঝায় আমার মন ভাল করার চেষ্টা করে। বলে তুই কি আমার থেকে তোর আপুকে বেশি ভালবাসিস নাকি। আমি হাসি, কি বলে আম্মু। আমার মা না থাকলে সেই সময় পার করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। আমার মা আমাকে ভুল বুঝেনি এজন্য আমার মায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি জানি আমার সেই সময়ের অবস্থা দেখে কেউ যদি অন্য কিছু ভাবত তাহলে তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যেত না। আমার অবস্থা বুঝার মত পরিস্থিতি ছিল শুধু আমার আপুসোনার। সেই যখন বুঝেনি তাহলে আর কি।
সময় গেলে নাকি সব কিছুই হালকা হয়ে যায়। কিন্তু এখনো আমি আমার আপুসোনার সাথের সেই ৭ মাসকে অসম্ভব মিস করি। প্রতি রাতে ভাবি আজ যদি আসে একটা মেসেজ যে পিচ্চি আয় নেটে কত্তদিন তোর সাথে আড্ডা দেই না। অসুস্থ হলে ভাবি এই বুঝি আপুসোনা ফোন করবে।
আমার আপুসোনার জীবনের জটিলতা কেটে যায় একসময়। চাকরী হয় ওর। বিয়েও হয়। জীবনে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে ও। এখন আর আমাকে ফিল করলেও আগের মত সময় দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আমিও ওকে অনেক বুঝতে পারি ওর অপারগতাটুকু আমাদের সম্পর্কের লিমিটটুকু।তোর পিচ্চি অনেক বড় হয়ে গেছেরে আপু। এখন আর অবুঝ নেই। আমাকে ও এখন নিয়মিত মেসেজ দেয়। আমার খবর নেয়। হঠাৎ হঠাৎ ফোন ও। দেশ থেকে আসা একটা ফোন এমনিতেই কত আকাঙ্খিত আর তা যদি হয় এরকম একজন প্রিয় মানুষের। ফোনে ওর নাম্বার দেখলেই আমার মন অসম্ভব ভাল হয়ে যায়। মন যখন খারাপ থাকে খুব তখন খুব করে চাইতে থাকি ওর একটা ফোন আসুক। ওকে এখন আর আমি ফোন করিনা, চিঠি লেখিনা। কথাটা মনে হয় ভুল বললাম। ফোন করিনা ঠিকই কিন্তু প্রায় রাতেই ওর সাথে কল্পনায় ফোনে কথা বলি আমি। চিঠি হয়ত পাঠাই না তবে ওকে লেখা চিঠি জমা হয় আমার ডায়েরীতে। ওর শান্ত জীবনে আমি আর বিরক্ত করতে চাই না। আমার আপুসোনা সুখে থাকুক অনেক। ও যেন আর কখনো আমার কোন আচরণে বিরক্ত না হয় এজন্য সবসময়ই সতর্ক থাকি আমি যদিও সম্পর্কের এইসব আরোপিত জিনিসে আমার অনেক আপত্তি। আমি জানি হয়ত ও এখন আমাকে আগের মত পিচ্চিসোনা , বাবুয়া ডেকে আদর করে ওর আদর প্রকাশ করে না তবে আমি এখনো ওর ছোটভাই আছি। আমি এইটা বিশ্বাস করতে চাই। সত্য কিনা নাই বা নিলাম তার খবর।
আমার আপুসোনা আজীবন আমার কাছে আপুসোনাই থাকবে। হয়ত জীবনের নানা ঝামেলায় দুদিন পরে ওর সাথে আমার এখন যে নিয়মিত যোগাযোগটা আছে সেটাও থাকবে না। হয়ত ব্যস্ততার কারনে ও আর আমার কথা মনে করার সময় ও পাবে না। আমিও হয়ত ওর কথা ভাবতে ভাবত আর কোন পাত্তা না পেতে পেতে একসময় ওর কথা ভুলে যাব, তখন আর আজকের মত আপুসোনা আপুসোনা করব না, আমার জীবনেও হয়ত অনেক ব্যস্ততা আসবে , আরো অনেক কাছের মানুষ আসবে যাদের ভীড়ে একসময়ের সেই অসম্ভব ভাললাগা ৭ মাস বিস্মৃত হয়ে যাবে তবুও কোন একদিন যদি এই লেখা কিংবা আমার আপুসোনার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু একটা আমার চোখে পড়ে সেদিন আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব এমন একটা আপুসোনা আমার ছিল। শুধু একটাই আফসোস আল্লাহ যদি ওকে আমার নিজের আপন আপু করে দিত তাহলে প্রাণ ভরে ওকে ভালবাসতে পারতাম।
আপুসোনা তুই অনেক অনেক সুখে থাক। তোর সব দুঃখ যদি আমি নিয়ে নেই তারপর যদি তোর আর কখনো দুঃখ না আসে তাহলেও আমার এতটুকু কষ্ট থাকবে না। আমি জানিনা তোমার হয়ত মাঝে মাঝে মনে হতে পারে তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ সেজন্য তোমাকে বলছি আমি যতটুকু কষ্ট পেয়েছি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তবে সবাই সেইরকম জায়গায় যেতে পারে না। এতটুকু কষ্ট দেওয়ার জন্য একটা যোগ্যতা লাগে। তুমি সেই যোগ্যতা অর্জন করেছিলে। আমার সবচেয়ে কষ্ট লাগত একটা কথা ভেবে একদিন আসবে যখন তুমি আমাকে ইগনোর করলেও আমি কষ্ট পাব না কারন তুমি তখন আর আমার আপুসোনা থাকবে না। আপুসোনা তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসি। আমার এই ছোট্ট জীবনে আমি আমার ফ্যামিলির বাইরে তোমার থেকে বেশি ভাল আর কাউকে কখনো বাসিনি।

No comments: