" মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?"
এই প্রশ্নটা আজীবন খুঁজে ফিরছি। একটু একটু যখন বড় হলাম গল্পের বই পড়া শুরু করলাম তখন এই ইচ্ছাটা দিনকে দিন বাড়তে লাগল। শরৎচন্দ্রের বড়দিদি, মেঝদি, পড়তে পড়তে ছোট্ট আমার কত দীর্ঘশ্বাস বের হল তার খবর কেউ রাখেনি। কেন যে আমার এত বোনের শখ আমি নিজেও জানিনা। আসলেই কি বোনরা অনেক বেশি আদর করে? আমার যেহেতু বোন নেই তাই আমার এই বিষয়ে অনেক কল্পনা অনেক রকমের চিন্তাভাবনা। যদি শুধু চিন্তার উপর পিএইচডি থাকত তাহলে আমি পেয়ে যেতাম। কত রকম চিন্তা যে করি আমার একটা বোন থাকলে এই করত ওই করত। পরবর্তীতে এক ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম উনার বড় আপু নাকি হোষ্টেলে থাকত উনি বাসায় এসেই প্রথমে নাকি আম্মুর সাথে একটা ঝগড়া করত কারন হচ্ছে তার আগেই নাকি উনি বোনের কাছে বিচার দিয়ে দিতেন অমুক দিন তমুক দিন মা ওনাকে মেরেছেন। আর আমি মনে মনে ভাবি ইশশ , আমি তো এইরকম একটা বড় বোন চেয়েছিলাম।
এই জন্যই মনে হয় ছোটবেলা থেকেই আমি আমার আশে পাশে সবসময় বড়বোন খুঁজেছিলাম। সেই খোঁজার ফলে আমার জীবনে অনেক গুলা আপুই এসেছে। কেউ কেউ আমাকে আসলেই ছোটভাইর মত আদর করেছে কাউকে কাউকে আমি নিজেই মনে মনে আপুর আসন দিয়েছি উনি হয়ত জানেই না।
সবার সাথে যে আজ যোগাযোগ আছে তাও না। কিন্তু মাঝে মাঝেই হঠাৎ করে কারো কথা মনে পড়ে। সেই আপুদের গল্প আমার এই কাজলাদিদিরা। ]
আমি এখন যদি কাউকে বলি যে ছোটবেলায় আমি একেবারেই চুপচাপ ছিলাম। কথাই বলতাম না খুব একটা। এমন কথাও প্রচলিত ছিল যে আমাকে নাকি বোম মেরেও কথা বের করা যায় না। কোথাও গেলেই আমার প্রথম কাজ ছিল আশে পাশে খুঁজে একটা গল্পের বই বের করে ফেলা। তারপর কোন এক কোনায় গিয়ে সেটা গেলা। সবাই আমাকে সেইরকমই জানত। ক্যাডেট কলেজে ঢুকে তখন সবে মাত্র সবার কাছে পাত্তা পেতে শুরু করেছি। ছোট্ট একটা বাচ্চা একা বাইরে থাকে সবার কাছে তাই ছুটিতে আসলে আমার অনেক দাম। সবাই এটা ওটা জানতে চায়। আমিও টুকটাক কথায় তার উত্তর দেই। তখন ক্লাস ৮ এ পড়ি। আব্বু মারা গেছেন মাত্রই। আমি ছুটিতে এসেছি তখন আব্বুর জন্য মিলাদ হবে। আমার আব্বু মারা যাবার আগে ১১ মাস অসুস্থ ছিল। তখন আমার এক দূর সম্পর্কের মামা আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। ছোট বেলা থেকেই আমরা ঐ বাসায় গিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকি কেন যেন ঐ মামীকে আমরা ভয় পেতাম। ওনার ভয়ে কত অখাদ্য যে খেতে হইছে ( শাকসব্জী ) ।
আব্বুর মিলাদ এর ব্যবস্থা সব করছেন ঐ মামা। আমার বড় ভাই আর আমি গেলাম সেখানে কি একটা কাজে। বড়ভাইয়া কথা বলছে মামী, মামাত ভাই আর বোনের সাথে। আমি সবসময়ের মতই একটা ম্যাগাজিন টেনে নিলাম। হঠাৎ পিয়া আপু এসে আমার থেকে সেটা কেড়ে নিল। বলল এত জ্ঞান অর্জন করতে হবে না কথা বল আমাদের সাথে। আপু ডিগ্রী পড়ে আর আমি সেভেন এর একটা ছেলে। ওনার সাথে আমি কি কথা বলব। কিন্তু সেই কেড়ে নেওয়ার মধ্যে কিছু একটা ছিল বুঝতে পারিনি। এই আপুও ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার ছোটভাইকে আদর করে। আর কয়েকদিন ধরেই দেখছিলাম গত ১ বছরেই পান্থ ( আমার বড়ভাই ) এর সাথে তার খুবই খাতির। পান্থভাইয়াও পিয়াপু বলতে প্রায় অজ্ঞান। আমার ভাইকে কখনো কারো এরকম ফ্যান হতে দেখিনি।
আব্বুর মিলাদের দিন রাতে আপুদের যখন বিদায় দিচ্ছি তখন আপু এসে আমাকে বলল , তপু পান্থ আমাকে তুমি করে বলে তুমিও আমাকে তুমি করে বলবা। আমি তো হা হয়ে গেলাম। এরপর ১ সপ্তাহ ছিলাম ঢাকায়। এর আগে কখনো আমি ফোনে কথা বলিনি। সেই সময় ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে আপুকে ফোন করলাম। কথা বলতে গিয়ে তুমি আপনি এসবে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। মনে আছে কলেজে গিয়েও খালি ভাবতাম এতদিনে বুঝি আমার একটা কাজলাদিদি এসে হাজির হয়েছে।
তারপর থেকে শুরু হল আমার চিঠি লেখা আমার পিয়াপু কে। মনের আনন্দে আমি শুধু আপু আপু লেখতাম। এক চিঠিতে মনে হয় আমি ১০-১৫ বার আপু আপু ডাকতাম। ছোট্ট বেলা থেকে মনের ভিতরে জমে থাকা ডাকটা চান্স পেয়ে যত বেশি ডাকা যেত তত ডাকতাম।
কলেজ থেকে ছুটিতে আসলে কখন পিয়াপুকে দেখতে যাব তাই ভাবতাম শুধু। কিন্তু তখনো আমার এই মুখচোরা স্বভাব চেঞ্জ হয়নি তাই গিয়েও খুব বেশি কথা বলতে পারতাম না। আমার থেকে আমার বড় ভাইই বেশি কথা বলত। আমিও অনুভব করতাম পিয়াপু আমার থেকে আমার বড় ভাইকেই বেশি আদর করে। ও সবসময় ঢাকায় থাকে প্রায়ই তার সাথে দেখা হয় এজন্য তার সাথেই বেশি ফ্রি। আর আমি ? চিঠিতেই আপু আপু সামনে আসলে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারিনা।
এইভাবে কেটে গেল অনেকদিন। কলেজে যতদিন ছিলাম প্রতি টার্মে তাকে চিঠি লেখতাম। পিয়াপু আমার চিঠির আপু। মনে আছে তখন ভাবতাম কলেজ থেকে বের হলে তো সবসময় ঢাকাতেই থাকব। আমার সাথেও আপুর সম্পর্কটা আস্তে আস্তে পান্থ ভাইয়ার মত হবে। কিন্তু কলেজ থেকে বের হয়ে যে কি হল চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেল আমার আপুটাও কেমন যেন দূরে সরে গেল। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আরো ব্যস্ত হয়ে গেল। খুব মজা হত কোন বারই আমার জন্মদিন মনে রাখতে পারতনা আপু। আমি ফোন করে বলতাম কি আপু এবারও ভুলে গেলা।
একসময় বিদেশ চলে আসলাম। প্রথম চিঠি লিখেছিলাম আম্মু আর পিয়াপুকে। দুটা চিঠির একটাও গিয়ে পৌঁছায়নি। এরপর আর লেখা হয়নি। আস্তে আস্তে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পিয়াপুর সাথে। তবুও বছরের দুটা দিন পিয়াপুকে ফোন দিতাম। তার জন্মদিনে উইশ করতে। আর আমার জন্মদিনে। সে মনে রাখতে পারতনা। আমিও আর বলতাম না যে আজ আমার জন্মদিন। আস্তে আস্তে ভুলতে বাধ্য হলাম কারণ যতদিন মনে হত কেমন যেন খারাপ লাগত।
এবারো দেশে গিয়ে আপুর সাথে ফোনে কথা হল। সে অনেকবারই বলছিল আমি কিন্তু তপু তোমাকে অনেক আদর করি। আমি মনে মনে বললাম হয়তবা সত্য কিন্তু সেকথা এখন তোমাকে মুখে বলতে হচ্ছে। দেখা করিনি ইচ্ছে করেই।
No comments:
Post a Comment