গোলামের গর্ভধারিণী- হুমায়ুন
আজাদ
====================
আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনি
আমার অচেনা
নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার
মায়েদের আমি
মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো
গরিব পিতার ঘরে
বেড়ে উঠেছেন দুঃক্ষিণী
বালিকারূপে ধীরেধীরে;
দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলের
মতো ফুটেছেন
ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক'রে
তুলেছেন মাতা
ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল
ভয়েরই কারণ।
তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে
দিয়েছেন
পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব
ঘরে;
স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে
জুটেছে কখনো, তবে
অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য,
পীড়ন, খণ্ড
প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয়
স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ
ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন।
বঙ্গীয় নারীর
আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে
পুত্রকন্যা,
আপনার মরদ বছরে একটা নতুন
ঢাকাই
শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে
উপহার
দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক
কৃশকায়
রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার
শুষ্ক বুক
ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র
জলের উচ্ছ্বাস।
চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি
আপনাকে মুগ্ধ
আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের
স্নিগ্ধ মুখ,
আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও
চেয়েছেন জানি
আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত
মানুষ। তাকে
দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে
না সততার
পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়,
পীড়নে বা
প্রলোভনে সে কখনো বুটদের সেজদা
করবে না।
আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা
নয়, আপনি
আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র
যদি হতো
সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন
শ্রমিক, কিংবা
তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি
উপযুক্ত
শিক্ষা দিতে পারেন নি
সন্তানকে;- এই পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক,
এখানে মোহর
ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও
জোটে না। তবে এতে
আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি;
কারণ আপনি
পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও
রকম কিছুই
চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার
পুত্র হোক
সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ।
আপনার সমস্ত
পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ ক'রে
বিশশতকের এই
এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র
কী হয়েছে
আপনি কি তা জানেন তা, হে অদেখা
দরিদ্র জননী?
কেনো আপনি পুত্রকে
পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের
এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে
কৃষক এসে লিপ্ত
হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের
রাখাল তার
নদী আর মাঠ হ'য়ে ওঠে হাবশি
গোলাম?
আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার
পুত্র শহরের
অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ?
আপনি এখন
তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন,
আপনার পুত্রের দিকে
তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না
চোখে, শুধু
একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে।
দশকে দশকে
যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা
দিয়েছেন মুঘলদের
এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের
প্রত্যেকের
পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে
পৃষ্ঠদেশ জুড়ে
জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার
পৃষ্ঠদেশ
একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;-
মরুভূমিতে কিম্ভুত
বহুকুঁজ উটের মতোই এখন দেখায়
তাকে।
সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম
মজলিশের
বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও
তার ইয়ারেরা
এতোই দক্ষ যে প্রাচীন,
ঐতিহাসিক গোলামদের
গৌরব হরণ ক'রে তারা আজ মশহুর
গোলাম
পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার
তুলতে পারে না,
এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও
একটি
মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ
কুঁজটিকেই মাথা
ব'লে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের পর
স্বাভাবিক পদ্ধতিও
বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের
পাদুকার তলে
প'ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া
আর কিছুতেই
পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র,
একদা আপনার
স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে
জীবন ধারণ
করতো যে বালক বয়সে। এখন সে
শত্রু পাখি
ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমন কি
সে আপনার
স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্য
দুঃক্ষ করি না, কতোই
তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে
শতকে শতকে।
কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব
কৃষক-কন্যা, দুঃক্ষী
মাতা, গরিব-গৃহিণী, আপনার জন্যে
বড় বেশি
দুঃখ পাই;- আপনার পুত্রের
গোলামির বার্তা আজ
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা
পৌঁছে গেছে তিতাসের
জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে,
লাউয়ের
মাঁচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের
উঠানের কোণে।
তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল
ক'রে
ওঠে, 'ওই দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে'; মাঠে
পাখি ডেকে ওঠে, 'দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে';
আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটি
থেকে
দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, 'গোলামের
গর্ভধারিণীর
হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে',
প্রতিবেশী
পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত
ক'রে কলকণ্ঠে
বলে, 'দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে।' এমন কি
প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা
শুনতে পান
'গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী'
স্বর ঘিরে ফেলছে
চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম
বিশ্রাম
নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো
মাটি ফুঁড়ে
মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের
কানে কানে ব'লে
যাবে, 'এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক
গর্ভধারিণী
গোলামের।' ভিজে উঠবে মাটি
ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।
কী দোষ আপনার? মা কি কখনোও জানে
দশমাস
ধ'রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ
না গোলাম?
Tuesday, October 13, 2009
Sunday, August 2, 2009
এ টেল এট নাইট
-পিচ্চি আমার উপর খুব রাগ হয়েছে ভাইয়া? তখন খুব মেজাজ খারাপ ছিল এইজন্য তোকে বকেছি রাগ করিস না ভাইয়া দেখ আমার কত খারাপ লাগছে।
অভিমানে চোখ ভারী হয়ে আসে পিচ্চিটার, তাকায় না আপুর দিকে।
এবার কিন্তু নিজেই মুখটি হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের দিকে ফেরায় আপু, খুব বেশি রাগ হয়েছে সোনা? আয় আর পড়তে হবে না ঘুমাবি। আজ আমার সাথে ঘুমাবি তুই আমি তোকে গল্প শোনাব।
এবার পিচ্চি ঠিকই কেঁদে দেয়। চোখ মুছতে মুছতে আপুর কোলে উঠে পড়ে।
-এই আপুসোনা তুই বলেছিস গল্প শোনাবি।
- হ্যা বলছিরে সোনা, একটু ঠিক করে নেই। পিচ্চিটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প ঠিক করে আপু।
এক জংগলে এক খুব দুখী একটা মেয়ে ছিল। তার এই পৃথিবীতে কেউ নাই। একা একা একটি কুড়েঘরে থাকে মেয়েটি...
-ওর কোন পিচ্চিসোনা নাই আপুসোনা?
-ঐ গাধা পিচ্চিসোনা থাকলে কি আর ও দুখী হয়?
-আহারে, তারপর?
-সেই মেয়ে একা একা জঙ্গলে থাকে খাবার জোগাড় করে রান্না করে ,খাওয়া দাওয়া করে আর গুনগুন করে গান করে। রাতের বেলায় ওর গলায় খুবই করুণ গান চলে আসে। সেটা শুনে পশুপাখিরা পর্যন্ত চোখে পানি চলে আসে।
- ও কি রাজকন্যা আপুসোনা?
- আরে না। ও একেবারেই সাধারন একটা মেয়ে। রাজকন্যারা তো খুব সুন্দর হয় এই মেয়ে তো এত সুন্দর না, আমার মত অনেকটা।
- তুই সুন্দর না এটা কে বলেছে? তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর।আপুসোনাকে জড়িয়ে ধরে বলে পিচ্চি।
-এইজন্যই তো বলেছিলাম ওই মেয়ের যদি একটি পিচ্চিসোনা থাকত তাহলে কি আর ও দুখী হত। হুমম তারপর শোন সেই মেয়ে কিন্তু মনে মনে একটা রাজপুত্রের জন্য অপেক্ষা করে। ও ভাবতে থাকে একদিন এক রাজপুত্র এসে ওকে নিয়ে যাবে ।
-কেন?
-একবার এক খুব বুড়ো একটা লোক ওর কুড়েঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় পানির তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছিল । মেয়েটি তখন খুব আদর করে বুড়োটার সেবা করেছিল। বুড়ো খুশি হয়ে বলেছিল মা আমি তোকে বর দিলাম তোর রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে। মেয়েটি ফিক করে হেসে দিয়ে বলেছিল তুমি কি সন্ন্যাসী? বুড়োও হেসে বলেছিল সন্ন্যাসী না হলে কি বর দেওয়া যায় না? তুই এত লক্ষী একটি মেয়ে তোর বর লাগবে কেন তোর এমনিতেই রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে।
-তাহলে তো আর বিয়ে হবে না রাজপুত্র আসবে না। পিচ্চির সুচিন্তিত মন্তব্য।
-কেন?
- ওমা তুমি দেখি কিছু জাননা সন্ন্যাসী না হলে কি আর বর কাজ করে?
- করেরে পিচ্চি করে। তুই যদি খুব ভাল কিছু কাজ করিস আর কেউ যদি মন থেকে তোর জন্য দোয়া করে তাহলে কাজ করে। আমিই তো বর পেয়েছি।
- তাই কবে আপুসোনা? তোর সাথে সন্ন্যাসীর দেখা হয়েছিল বুঝি?
- উহু। সন্ন্যাসী না অনেক আগে তখন তুই ছিলি না। আমিও এরকম এক বুড়ো ফকিরকে পানি দিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছিল খুকী তোমার কি চাই।
-কি চাইছিলি তুই?
-আমি বলেছিলাম , আমার পুতুল আমার সাথে কথা বলে না আমার একটা জীবন্ত পুতুল চাই।
-পেয়েছিলি আপুসোনা জীবন্ত পুতুল?
- হ্যা পেয়েছি। তার অল্প কিছুদিন পরেই পেয়েছি।
- কি বলিস আপুসোনা আমাকে দেখাস নি তো।
পিচ্চিটাকে জড়িয়ে ধরে উত্তর দেয় আপুসোনা " তোকে কিভাবে দেখাই , তুইই তো আমার সেই জীবন্ত পুতুল " । বোকার মত হাসে পিচ্চি আপুসোনার আদর পেয়ে।
- তারপর কি হল ঐ মেয়েটার।
- ওহহ, তো সেই মেয়ে বসে থাকে রাজপুত্রের আশায় মনে মনে ভাবে হতেও তো পারে সেই বৃদ্ধ লোকটি কোন ছদ্মবেশী সন্ন্যাসী। রাজপুত্র তো আর আসে না। একদিন এক ছেলে আসল তাকে দেখে কিছুতেই রাজপুত্র মনে হয় না। মেয়েটিকে দেখে মায়া লেগে গেলে ছেলেটির। সে প্রতিদিন সেখানে আসা শুরু করে দিল। মেয়েটি কিন্তু তার সাথে খুব একটা কথা বলে না কারণ সে যে রাজপুত্রের আশায় থাকে। ছেলেটি নানাভাবে মেয়েটিকে খুশি করতে চায় কোনদিন হয়ত জংলী ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে নিয়ে আসে কোনদিন আবার নিয়ে আসে লাল টকটকে গোলাপ। মেয়েটি সেগুলো হাতে নিয়ে বসে বসে কি যেন ভাবে। ছেলেটি মন খারাপ করে আস্তে আস্তে চলে যায়। একদিন সত্যি সত্যি কিন্তু এক রাজপুত্র এই মেয়েটির দুয়ারে আসল। রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে এসেছে তার ঘোড়া এবং সে দুজনই ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত। মেয়েটি খুশিতে আত্মহারা এতদিনে তার মনের মানুষ আসল বুঝি। সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল রাজপুত্রের সেবা করে দেবার জন্য। কিন্তু রাজপুত্র তো রাজপুত্র তার এতে মন গলবে কেন। প্রথমেই মেয়েটির দেওয়া পেয়ালায় করে সে পানি খেতে অস্বীকার করল। সে সোনার গ্লাস ছাড়া কোনদিন পানি খায়নি। মেয়েটি একটু দমে যায়। তারপরও রাজপুত্রের জন্য জীবন দেওয়ার জন্য তৈরি থাকে সে। রান্না করে খাওয়াবার চেষ্টা করে রাজপুত্র কে। ক্ষিদেয় কাতর রাজপুত্র খাবার সময় তাই আর সোনার থালার আবদার করে না কিন্তু খাওয়া শেষেই তার রাজরক্ত আবার ফুটে উঠে টগবগ করে। সে মেয়েটিকে ডাকে, " এই তুই এসে আমার পা টিপে দেয়"। একটু অবাক হয়ে উঠে মেয়েটি রাজপুত্রের এহেন কথা শুনে। কিন্তু রাজপুত্রের সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই। এমন ৪-৫ টি দাসী প্রতিদিন ওর সেবা করার জন্য প্রস্তুত থাকে সবসময়। মেয়েটি রাজপুত্রের পা টিপে দিতে দিতে চোখের পানি ফেলতে থাকে। সেই ছেলেটি যেটি মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছি সে কিন্তু চুপিসারে এসে দেখে মন খারাপ করে চলে গেছে। রাজপুত্র ঘুম থেকে উঠে চলে গেল ঘোড়া হাঁকিয়ে। মেয়েটি সেই থেকে কাঁদছে। এমন সময় মেয়েটির সামনে এসে দাড়াল সেই ছেলেটি। এসে ওকে তুলে নিল বুকে। মেয়েটির কান্না বেড়ে গেল দ্বিগুন। ছেলেটি মেয়েটির কান্না মুছে দিল ঘরে নিয়ে গেল এবং বের করে দিল আজকে আনা এতদিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোলাপ। এরপর বলল তোমাকে ভালবাসার একটু অধিকার দাও আমায় দেখবে আমি রাজপুত্র না হতে পারি , হাতি ঘোড়ায় ঘাটতি থাকতে পারে কিন্তু আমার ভালবাসায় কোনদিন ঘাটতি পাবে না। মেয়েটি দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল আমাকে ক্ষমা কর আমি আসল রাজপুত্র চিনতে পারিনি তুমিই আমার জীবনের রাজপুত্র।
-কিরে পিচ্চিসোনা ঘুমিয়ে পড়লি।
সাড়াশব্দ না পেয়ে আপু দেখল পিচ্চি তাকে জড়িয়ে ধরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বালিশ ঠিক করে দিল, ঘুমন্ত ছোট্ট ভাইটা যেন তার একটি এঞ্জেল। পিচ্চিটার কপালে একে দিল চুমুর চিহ্ন।
অভিমানে চোখ ভারী হয়ে আসে পিচ্চিটার, তাকায় না আপুর দিকে।
এবার কিন্তু নিজেই মুখটি হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের দিকে ফেরায় আপু, খুব বেশি রাগ হয়েছে সোনা? আয় আর পড়তে হবে না ঘুমাবি। আজ আমার সাথে ঘুমাবি তুই আমি তোকে গল্প শোনাব।
এবার পিচ্চি ঠিকই কেঁদে দেয়। চোখ মুছতে মুছতে আপুর কোলে উঠে পড়ে।
-এই আপুসোনা তুই বলেছিস গল্প শোনাবি।
- হ্যা বলছিরে সোনা, একটু ঠিক করে নেই। পিচ্চিটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প ঠিক করে আপু।
এক জংগলে এক খুব দুখী একটা মেয়ে ছিল। তার এই পৃথিবীতে কেউ নাই। একা একা একটি কুড়েঘরে থাকে মেয়েটি...
-ওর কোন পিচ্চিসোনা নাই আপুসোনা?
-ঐ গাধা পিচ্চিসোনা থাকলে কি আর ও দুখী হয়?
-আহারে, তারপর?
-সেই মেয়ে একা একা জঙ্গলে থাকে খাবার জোগাড় করে রান্না করে ,খাওয়া দাওয়া করে আর গুনগুন করে গান করে। রাতের বেলায় ওর গলায় খুবই করুণ গান চলে আসে। সেটা শুনে পশুপাখিরা পর্যন্ত চোখে পানি চলে আসে।
- ও কি রাজকন্যা আপুসোনা?
- আরে না। ও একেবারেই সাধারন একটা মেয়ে। রাজকন্যারা তো খুব সুন্দর হয় এই মেয়ে তো এত সুন্দর না, আমার মত অনেকটা।
- তুই সুন্দর না এটা কে বলেছে? তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর।আপুসোনাকে জড়িয়ে ধরে বলে পিচ্চি।
-এইজন্যই তো বলেছিলাম ওই মেয়ের যদি একটি পিচ্চিসোনা থাকত তাহলে কি আর ও দুখী হত। হুমম তারপর শোন সেই মেয়ে কিন্তু মনে মনে একটা রাজপুত্রের জন্য অপেক্ষা করে। ও ভাবতে থাকে একদিন এক রাজপুত্র এসে ওকে নিয়ে যাবে ।
-কেন?
-একবার এক খুব বুড়ো একটা লোক ওর কুড়েঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় পানির তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছিল । মেয়েটি তখন খুব আদর করে বুড়োটার সেবা করেছিল। বুড়ো খুশি হয়ে বলেছিল মা আমি তোকে বর দিলাম তোর রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে। মেয়েটি ফিক করে হেসে দিয়ে বলেছিল তুমি কি সন্ন্যাসী? বুড়োও হেসে বলেছিল সন্ন্যাসী না হলে কি বর দেওয়া যায় না? তুই এত লক্ষী একটি মেয়ে তোর বর লাগবে কেন তোর এমনিতেই রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে।
-তাহলে তো আর বিয়ে হবে না রাজপুত্র আসবে না। পিচ্চির সুচিন্তিত মন্তব্য।
-কেন?
- ওমা তুমি দেখি কিছু জাননা সন্ন্যাসী না হলে কি আর বর কাজ করে?
- করেরে পিচ্চি করে। তুই যদি খুব ভাল কিছু কাজ করিস আর কেউ যদি মন থেকে তোর জন্য দোয়া করে তাহলে কাজ করে। আমিই তো বর পেয়েছি।
- তাই কবে আপুসোনা? তোর সাথে সন্ন্যাসীর দেখা হয়েছিল বুঝি?
- উহু। সন্ন্যাসী না অনেক আগে তখন তুই ছিলি না। আমিও এরকম এক বুড়ো ফকিরকে পানি দিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছিল খুকী তোমার কি চাই।
-কি চাইছিলি তুই?
-আমি বলেছিলাম , আমার পুতুল আমার সাথে কথা বলে না আমার একটা জীবন্ত পুতুল চাই।
-পেয়েছিলি আপুসোনা জীবন্ত পুতুল?
- হ্যা পেয়েছি। তার অল্প কিছুদিন পরেই পেয়েছি।
- কি বলিস আপুসোনা আমাকে দেখাস নি তো।
পিচ্চিটাকে জড়িয়ে ধরে উত্তর দেয় আপুসোনা " তোকে কিভাবে দেখাই , তুইই তো আমার সেই জীবন্ত পুতুল " । বোকার মত হাসে পিচ্চি আপুসোনার আদর পেয়ে।
- তারপর কি হল ঐ মেয়েটার।
- ওহহ, তো সেই মেয়ে বসে থাকে রাজপুত্রের আশায় মনে মনে ভাবে হতেও তো পারে সেই বৃদ্ধ লোকটি কোন ছদ্মবেশী সন্ন্যাসী। রাজপুত্র তো আর আসে না। একদিন এক ছেলে আসল তাকে দেখে কিছুতেই রাজপুত্র মনে হয় না। মেয়েটিকে দেখে মায়া লেগে গেলে ছেলেটির। সে প্রতিদিন সেখানে আসা শুরু করে দিল। মেয়েটি কিন্তু তার সাথে খুব একটা কথা বলে না কারণ সে যে রাজপুত্রের আশায় থাকে। ছেলেটি নানাভাবে মেয়েটিকে খুশি করতে চায় কোনদিন হয়ত জংলী ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে নিয়ে আসে কোনদিন আবার নিয়ে আসে লাল টকটকে গোলাপ। মেয়েটি সেগুলো হাতে নিয়ে বসে বসে কি যেন ভাবে। ছেলেটি মন খারাপ করে আস্তে আস্তে চলে যায়। একদিন সত্যি সত্যি কিন্তু এক রাজপুত্র এই মেয়েটির দুয়ারে আসল। রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে এসেছে তার ঘোড়া এবং সে দুজনই ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত। মেয়েটি খুশিতে আত্মহারা এতদিনে তার মনের মানুষ আসল বুঝি। সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল রাজপুত্রের সেবা করে দেবার জন্য। কিন্তু রাজপুত্র তো রাজপুত্র তার এতে মন গলবে কেন। প্রথমেই মেয়েটির দেওয়া পেয়ালায় করে সে পানি খেতে অস্বীকার করল। সে সোনার গ্লাস ছাড়া কোনদিন পানি খায়নি। মেয়েটি একটু দমে যায়। তারপরও রাজপুত্রের জন্য জীবন দেওয়ার জন্য তৈরি থাকে সে। রান্না করে খাওয়াবার চেষ্টা করে রাজপুত্র কে। ক্ষিদেয় কাতর রাজপুত্র খাবার সময় তাই আর সোনার থালার আবদার করে না কিন্তু খাওয়া শেষেই তার রাজরক্ত আবার ফুটে উঠে টগবগ করে। সে মেয়েটিকে ডাকে, " এই তুই এসে আমার পা টিপে দেয়"। একটু অবাক হয়ে উঠে মেয়েটি রাজপুত্রের এহেন কথা শুনে। কিন্তু রাজপুত্রের সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই। এমন ৪-৫ টি দাসী প্রতিদিন ওর সেবা করার জন্য প্রস্তুত থাকে সবসময়। মেয়েটি রাজপুত্রের পা টিপে দিতে দিতে চোখের পানি ফেলতে থাকে। সেই ছেলেটি যেটি মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছি সে কিন্তু চুপিসারে এসে দেখে মন খারাপ করে চলে গেছে। রাজপুত্র ঘুম থেকে উঠে চলে গেল ঘোড়া হাঁকিয়ে। মেয়েটি সেই থেকে কাঁদছে। এমন সময় মেয়েটির সামনে এসে দাড়াল সেই ছেলেটি। এসে ওকে তুলে নিল বুকে। মেয়েটির কান্না বেড়ে গেল দ্বিগুন। ছেলেটি মেয়েটির কান্না মুছে দিল ঘরে নিয়ে গেল এবং বের করে দিল আজকে আনা এতদিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোলাপ। এরপর বলল তোমাকে ভালবাসার একটু অধিকার দাও আমায় দেখবে আমি রাজপুত্র না হতে পারি , হাতি ঘোড়ায় ঘাটতি থাকতে পারে কিন্তু আমার ভালবাসায় কোনদিন ঘাটতি পাবে না। মেয়েটি দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল আমাকে ক্ষমা কর আমি আসল রাজপুত্র চিনতে পারিনি তুমিই আমার জীবনের রাজপুত্র।
-কিরে পিচ্চিসোনা ঘুমিয়ে পড়লি।
সাড়াশব্দ না পেয়ে আপু দেখল পিচ্চি তাকে জড়িয়ে ধরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বালিশ ঠিক করে দিল, ঘুমন্ত ছোট্ট ভাইটা যেন তার একটি এঞ্জেল। পিচ্চিটার কপালে একে দিল চুমুর চিহ্ন।
Thursday, July 9, 2009
ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম
"বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্যালাইনের ফোঁটা গুনি। সকাল থেকে চলছে গতকাল রাতে হঠাৎ করে প্রচন্ড পেটে ব্যাথায় অজ্ঞান টাইপ হয়ে যাওয়ার সময় পাশের বাসা থেকে দুলাভাই এসে ঘুমের ওষুধ সিরিঞ্জ পুশ করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এই স্যালাইন চালু করে দিয়ে গেছেন। অলরেডি একটা শেষ হয়েছে এখন আরেকটা যাচ্ছে। এটাই নাকি শেষ এরপর চলাফেরা করতে পারব। বন্ধুরা এসেছিল দেখতে আম্মু ভীষণ রকম চিন্তিত। সবাই বলছে পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে এই চিন্তাতেই নাকি আমার এরকম হয়েছে। হতেও পারে তবে চিন্তা কি আসলেই করছি। কাল এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। গত একটা বছর এই দিনটার জন্য যা খাটাখাটুনি করেছি অবশেষে তার ফল বের হবে। চিন্তা হওয়াটা একেবারেই অমূলক কিছু না। তবে আমার পরীক্ষা দিয়ে আমি সন্তুষ্ট এবার হয়ত আর আমাকে এসএসসির মত সবাইকে হতাশ করতে হবে না। এসএসসি তে বাসায় সবাই চলে এসেছিল দুর্দান্ত একটা রেজাল্টের অপেক্ষা করে সেলিব্রেশন করার জন্য। আমাদের ফ্যামিলিতে একটা নতুন কিছু হবে সেই চিন্তায় সবাই খুব এক্সাইটেড ছিল। কিন্তু রেজাল্ট শুনে সবাই বড়ই হতাশ হয়েছিল। সবাইকে হতাশ করার দুঃখে আমি চুপ মেরে গিয়েছিলাম অনেক। সেদিন ভেবেছিলাম আর একটা চান্স আছে আমার একটাই। কাল সেইদিন। পরীক্ষা দিয়ে নিজের কোন ভুল বের হয়নি আমার কাছে বলা যায় যা যা লিখেছি সব আমার হিসেবে ঠিক উত্তর দিয়ে এসেছি টেস্ট পরীক্ষার চেয়েও ভাল হয়েছে পরীক্ষা তাও যদি না হয় ... । মর্তুজা বলছিল তপুর যদি না হয় তাহলে বোর্ডের সামনে গিয়ে অনশন করব চিন্তা কইরেন না আন্টি। আম্মু এসে আমাকে বলে যাচ্ছে এত চিন্তা করিস না আল্লাহ যা করেন ভালর জন্যই করেন। অথচ আমি জানি আমার আম্মুই সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করে আছেন আমার রেজাল্ট শোনার জন্য।
সকাল থেকে উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি। আগের রাতেও ছিলাম বিছানায় শোয়া আর আর শুয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না। কিভাবে কখন খবর পাওয়া যাবে তাই নিয়েই ভাবছি। মর্তুজার বাবা মোটামোটি কিভাবে যেন সকালেই খবর পেয়ে যান তাই আশায় আছি উনি কিছু একটা খবর জানাবেন। ১১ টা বেজে গেল দেখে এখন আবার শঙ্কা ভর করেছে আমার মাঝে আবারো... । ফোন দিলাম মীমকে শুনতে পারলাম মর্তুজার বাসায় এখন নাকি সাংবাদিক ওর রেজাল্ট জানলাম ওদের রেজাল্ট জানলাম আর মীমকে বললাম দেখ তো আমার রেজাল্ট জানতে পারিস কিনা। জানার সাথে সাথে আমাকে জানাবে বলল ও, নিজের রেজাল্ট উদযাপনে ব্যস্ত ও। অপেক্ষার প্রহর আর কাটে না। ৪ টা বাজলে কলেজে ফোন করে জানা যাবে তার আগ পর্যন্ত কিভাবে সময় কাটাই। গোসলে ঢুকলাম তখন আম্মু এসে খবর দিল মর্তুজা,মীম, মহিউদ্দিনের রেজাল্ট। মর্তুজার বাবা আম্মুকে ফোন করে জানিয়েছে এখনো আমার রেজাল্ট জানতে পারেন নি জানতে পারলে জানাবেন। হেসে বললাম তাহলে মনে হয় এবারও হয়নি মা এই জন্য আঙ্কেল জানাচ্ছে না। আম্মু মুখ কাল করে ফেললেন। আমি গোসলখানার দরজা আবার বন্ধ করে দিলাম।
গোসল করে বের হয়ে খাওয়া দাওয়া করেছি কিনা মনে নেই। ঘড়ি নিয়ে বসে ছিলাম কখন ৪ টা বাজে। আমার মামা যিনি ফেনীতে থাকেন তাকে দেওয়া হয়েছিল কলেজের ফোন নম্বর উনি ফোন করে খবর নিবেন আমাদের বাসায় ফোন নেই তাই খবর জানার জন্য মামার অপেক্ষায় বসে থাকি আমি। ৪ টা বেজে গেলেও কোন খবর আসে না আমি অস্থির হয়ে উঠি। ওদিকে আমার ছোটমামা যে কিনা তার চারপাশের সবাইকে আমার কথা আগে থেকেই বলে রেখেছে উনি একটা লিস্ট করে রেখেছেন তপুর রেজাল্ট পাওয়ার পর কাকে কাকে জানাতে হবে একটা বিশাল কাগজে, আমাদের অনেক বড় ফ্যামিলি সবাইকে যে সাথে সাথে সুখবরটুকু দেওয়া লাগবে। মামা ফোন দিলেন কলেজে। কলেজ থেকে জানানো হল স্টার ৪ লেটার। আর কিছু না। আমার মামা বিশ্বাস করতে পারেন নি আবার জিজ্ঞেস করেন একই উত্তর। মামা প্রথমেই কুটি কুটি করে ছিড়েন সকালে বানানো লিস্টটুকু। এরপর আমার মেঝখালা যিনি ফেনীতেই থাকেন তাকে ফোন করে দুঃসংবাদ দিলেন। খালা সাথে সাথে ঢাকা আসার প্রস্তুতি নিলেন আমাকে এবং আমার মা কে স্বান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। মামা নিজে অপারগতা প্রকাশ করলেন আমার মাকে খবর জানাবার জন্য উনি জানালেন আমার খালাত ভাই জামশেদ ভাইয়াকে। ওনারা দুজন আলাপ করে অবশেষে জামশেদ ভাইয়া ফোন দিল আমাদের বাড়িওয়ালার বাসায়। আম্মু ফোন ধরতে গেল আর আমি সিড়িমুখে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখলাম আম্মু নামছে সেখানে খুশির কোন চিহ্ন নেই। আমি কিছু জিজ্ঞেস করি না আম্মু আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেন আমি বললাম আমি একটু বের হই। আম্মু কাঁদছে আর আমাকে ধরে রেখেছেন বেরুতে দিবেন না। আমি বললাম আরে মা চিন্তা কইরেন না শুধু স্টার পাব তা হতেই পারে না একটা না একটা প্লেস তো পাবই আমাকে একটু বের হতে দেন। আম্মু বের হতে দেয় না আমি কি করব কে জানে এই জন্য। আমি বের হই জোর করে। বের হয়ে দেখি জামশেদ ভাইয়ার বউ কোথায় যেন যাচ্ছে ওনাকে বললাম মোবাইলটা দিয়ে যাও আমাকে। ও বলল টাকা নাই ১০ টাকা আছে নাও রাখ। ৭ টাকা মিনিটের যুগে একটার বেশি কল করতে পারব না বুঝতে পারলাম। সেটা হাতে নিয়ে দোকানে গেলাম। কলেজে ফোন করে পেলাম না লাইন। এরপর ফোন দিলাম এক ফ্রেন্ড কে ও ও বলল দোস্ত প্লেসের কথা তো কিছু বলল না শুধু বলল স্টার টুকু না নিয়ে শুধু রেজাল্ট নিয়েই কলেজে ফিরে এসেছিলেন তাই প্রথমে কাউকে রেজাল্ট বলা হচ্ছিল না। পরে অনেক ফোন পেয়ে ওনারা প্লেস ছাড়া রেজাল্ট বলা শুরু করেছিল। বাসায় ফিরে এসে ভাবছিলাম কি করি। এরই মধ্যে আমার মায়ের কান্নায় চারপাশের মানুষে আমাদের বাসা ভরে গেছে। সবাই ভেবেছে আমার কি না কি হল কারণ তার আগের দিনও আমি স্যালাইন নিয়ে শুয়ে ছিলাম।
আমার একটা ছোটবেলার বন্ধু আছে নাম রাজীব ও আবার আমার আম্মুর দিকের আত্মীয় । ও এসে বসে ছিল আমার পাশে। ও কে বললাম কি করি বল তো? বলল কারো ফোন নম্বর নেই তোর কাছে? আমি আমার ফোন বুক খুলে বসলাম একটা একটা নাম ওকে পড়ে শোনাই। পড়তে পড়তে মোস্তফা মামুন ( সিকক ) এর নাম বলি। ভাইয়া তখন প্রথম আলোর স্পোর্টস রিপোর্টার। রাজীব বলে ওনাকে ফোন কর। আমি বললাম টাকা নাই মিসকল দিতে পারব কিন্তু উনি আমার নম্বর চিনবেন না। তাও কি মনে করে মামুন ভাইকে মিসকল দিলাম। ২ মিনিট পরেই ফোন বেজে উঠল আমার মোস্তফা মামুন ভাই। আমি ফোন ধরেই গড়গড় করে ভাইয়াকে আমার পরিচয় দিলাম ভাইয়া আমি সিলেট ক্যাডেট কলেজ রিইউনিয়নে আপনার সাথে পরিচয় হয়েছে কামরুল নাম। এটুকু বলতেই ভাইয়া আমাকে বলল, " আরে কামরুল , কংগ্রাচুলেশন ম্যান...... আমি তো জানতাম তুমি শুধু কথাই বলতে পার "। মামুন ভাইকে কখনো বলা হয়নি ভাইয়া ধন্যবাদ কারণ এটুকু বলে বোঝানো যাবে না আমার কৃতজ্ঞতা। ভাইয়া আজীবন মনে রাখব আপনাকে যতদিন বেঁচে থাকব।
তখন বাজে সাড়ে ৫ টা। ফোন কানে ধরেই আমি আম্মুর কাছে আসলাম ফোন রেখে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম বললাম আম্মু আমি পেরেছি। এরপরের কিছু মিনিটের কথা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। আমার মা আবারো কাঁদলেন এবার খুশিতে। আমার জীবন সার্থক হয়ে গেল। ছোট বেলা থেকে এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম মনের গহীন কোনে। আমার মনে হল আমি পৃথিবীতে আর কিছু চাই না আমার আর কিছু লাগবে না। ওদিকে আমার মামা লিস্টটা ছিড়ে ফেলেছেন দেখে আফসোস করতে করতে এবং তাড়াহুড়ো করে যাকে যাকে পারলেন খবর দিলেন। আর আমি তখন স্বপ্নের রাজ্যে সেসময়ের অনুভূতি, ঘটনা পুরোটা চোখ বুঝে দেখতে চাইলে এখনো চোখে ভেসে উঠে কিন্তু প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যিই এরকম দিন সারাজীবনে একবারই আসে। জীবনের একটা দিন ফিরে পেতে চাইলে এই দিনটি হুবহু এইভাবেই আমি চাইব।
সকাল থেকে উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি। আগের রাতেও ছিলাম বিছানায় শোয়া আর আর শুয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না। কিভাবে কখন খবর পাওয়া যাবে তাই নিয়েই ভাবছি। মর্তুজার বাবা মোটামোটি কিভাবে যেন সকালেই খবর পেয়ে যান তাই আশায় আছি উনি কিছু একটা খবর জানাবেন। ১১ টা বেজে গেল দেখে এখন আবার শঙ্কা ভর করেছে আমার মাঝে আবারো... । ফোন দিলাম মীমকে শুনতে পারলাম মর্তুজার বাসায় এখন নাকি সাংবাদিক ওর রেজাল্ট জানলাম ওদের রেজাল্ট জানলাম আর মীমকে বললাম দেখ তো আমার রেজাল্ট জানতে পারিস কিনা। জানার সাথে সাথে আমাকে জানাবে বলল ও, নিজের রেজাল্ট উদযাপনে ব্যস্ত ও। অপেক্ষার প্রহর আর কাটে না। ৪ টা বাজলে কলেজে ফোন করে জানা যাবে তার আগ পর্যন্ত কিভাবে সময় কাটাই। গোসলে ঢুকলাম তখন আম্মু এসে খবর দিল মর্তুজা,মীম, মহিউদ্দিনের রেজাল্ট। মর্তুজার বাবা আম্মুকে ফোন করে জানিয়েছে এখনো আমার রেজাল্ট জানতে পারেন নি জানতে পারলে জানাবেন। হেসে বললাম তাহলে মনে হয় এবারও হয়নি মা এই জন্য আঙ্কেল জানাচ্ছে না। আম্মু মুখ কাল করে ফেললেন। আমি গোসলখানার দরজা আবার বন্ধ করে দিলাম।
গোসল করে বের হয়ে খাওয়া দাওয়া করেছি কিনা মনে নেই। ঘড়ি নিয়ে বসে ছিলাম কখন ৪ টা বাজে। আমার মামা যিনি ফেনীতে থাকেন তাকে দেওয়া হয়েছিল কলেজের ফোন নম্বর উনি ফোন করে খবর নিবেন আমাদের বাসায় ফোন নেই তাই খবর জানার জন্য মামার অপেক্ষায় বসে থাকি আমি। ৪ টা বেজে গেলেও কোন খবর আসে না আমি অস্থির হয়ে উঠি। ওদিকে আমার ছোটমামা যে কিনা তার চারপাশের সবাইকে আমার কথা আগে থেকেই বলে রেখেছে উনি একটা লিস্ট করে রেখেছেন তপুর রেজাল্ট পাওয়ার পর কাকে কাকে জানাতে হবে একটা বিশাল কাগজে, আমাদের অনেক বড় ফ্যামিলি সবাইকে যে সাথে সাথে সুখবরটুকু দেওয়া লাগবে। মামা ফোন দিলেন কলেজে। কলেজ থেকে জানানো হল স্টার ৪ লেটার। আর কিছু না। আমার মামা বিশ্বাস করতে পারেন নি আবার জিজ্ঞেস করেন একই উত্তর। মামা প্রথমেই কুটি কুটি করে ছিড়েন সকালে বানানো লিস্টটুকু। এরপর আমার মেঝখালা যিনি ফেনীতেই থাকেন তাকে ফোন করে দুঃসংবাদ দিলেন। খালা সাথে সাথে ঢাকা আসার প্রস্তুতি নিলেন আমাকে এবং আমার মা কে স্বান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। মামা নিজে অপারগতা প্রকাশ করলেন আমার মাকে খবর জানাবার জন্য উনি জানালেন আমার খালাত ভাই জামশেদ ভাইয়াকে। ওনারা দুজন আলাপ করে অবশেষে জামশেদ ভাইয়া ফোন দিল আমাদের বাড়িওয়ালার বাসায়। আম্মু ফোন ধরতে গেল আর আমি সিড়িমুখে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখলাম আম্মু নামছে সেখানে খুশির কোন চিহ্ন নেই। আমি কিছু জিজ্ঞেস করি না আম্মু আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেন আমি বললাম আমি একটু বের হই। আম্মু কাঁদছে আর আমাকে ধরে রেখেছেন বেরুতে দিবেন না। আমি বললাম আরে মা চিন্তা কইরেন না শুধু স্টার পাব তা হতেই পারে না একটা না একটা প্লেস তো পাবই আমাকে একটু বের হতে দেন। আম্মু বের হতে দেয় না আমি কি করব কে জানে এই জন্য। আমি বের হই জোর করে। বের হয়ে দেখি জামশেদ ভাইয়ার বউ কোথায় যেন যাচ্ছে ওনাকে বললাম মোবাইলটা দিয়ে যাও আমাকে। ও বলল টাকা নাই ১০ টাকা আছে নাও রাখ। ৭ টাকা মিনিটের যুগে একটার বেশি কল করতে পারব না বুঝতে পারলাম। সেটা হাতে নিয়ে দোকানে গেলাম। কলেজে ফোন করে পেলাম না লাইন। এরপর ফোন দিলাম এক ফ্রেন্ড কে ও ও বলল দোস্ত প্লেসের কথা তো কিছু বলল না শুধু বলল স্টার টুকু না নিয়ে শুধু রেজাল্ট নিয়েই কলেজে ফিরে এসেছিলেন তাই প্রথমে কাউকে রেজাল্ট বলা হচ্ছিল না। পরে অনেক ফোন পেয়ে ওনারা প্লেস ছাড়া রেজাল্ট বলা শুরু করেছিল। বাসায় ফিরে এসে ভাবছিলাম কি করি। এরই মধ্যে আমার মায়ের কান্নায় চারপাশের মানুষে আমাদের বাসা ভরে গেছে। সবাই ভেবেছে আমার কি না কি হল কারণ তার আগের দিনও আমি স্যালাইন নিয়ে শুয়ে ছিলাম।
আমার একটা ছোটবেলার বন্ধু আছে নাম রাজীব ও আবার আমার আম্মুর দিকের আত্মীয় । ও এসে বসে ছিল আমার পাশে। ও কে বললাম কি করি বল তো? বলল কারো ফোন নম্বর নেই তোর কাছে? আমি আমার ফোন বুক খুলে বসলাম একটা একটা নাম ওকে পড়ে শোনাই। পড়তে পড়তে মোস্তফা মামুন ( সিকক ) এর নাম বলি। ভাইয়া তখন প্রথম আলোর স্পোর্টস রিপোর্টার। রাজীব বলে ওনাকে ফোন কর। আমি বললাম টাকা নাই মিসকল দিতে পারব কিন্তু উনি আমার নম্বর চিনবেন না। তাও কি মনে করে মামুন ভাইকে মিসকল দিলাম। ২ মিনিট পরেই ফোন বেজে উঠল আমার মোস্তফা মামুন ভাই। আমি ফোন ধরেই গড়গড় করে ভাইয়াকে আমার পরিচয় দিলাম ভাইয়া আমি সিলেট ক্যাডেট কলেজ রিইউনিয়নে আপনার সাথে পরিচয় হয়েছে কামরুল নাম। এটুকু বলতেই ভাইয়া আমাকে বলল, " আরে কামরুল , কংগ্রাচুলেশন ম্যান...... আমি তো জানতাম তুমি শুধু কথাই বলতে পার "। মামুন ভাইকে কখনো বলা হয়নি ভাইয়া ধন্যবাদ কারণ এটুকু বলে বোঝানো যাবে না আমার কৃতজ্ঞতা। ভাইয়া আজীবন মনে রাখব আপনাকে যতদিন বেঁচে থাকব।
তখন বাজে সাড়ে ৫ টা। ফোন কানে ধরেই আমি আম্মুর কাছে আসলাম ফোন রেখে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম বললাম আম্মু আমি পেরেছি। এরপরের কিছু মিনিটের কথা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। আমার মা আবারো কাঁদলেন এবার খুশিতে। আমার জীবন সার্থক হয়ে গেল। ছোট বেলা থেকে এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম মনের গহীন কোনে। আমার মনে হল আমি পৃথিবীতে আর কিছু চাই না আমার আর কিছু লাগবে না। ওদিকে আমার মামা লিস্টটা ছিড়ে ফেলেছেন দেখে আফসোস করতে করতে এবং তাড়াহুড়ো করে যাকে যাকে পারলেন খবর দিলেন। আর আমি তখন স্বপ্নের রাজ্যে সেসময়ের অনুভূতি, ঘটনা পুরোটা চোখ বুঝে দেখতে চাইলে এখনো চোখে ভেসে উঠে কিন্তু প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সত্যিই এরকম দিন সারাজীবনে একবারই আসে। জীবনের একটা দিন ফিরে পেতে চাইলে এই দিনটি হুবহু এইভাবেই আমি চাইব।
Thursday, June 18, 2009
আপুসোনা, তুই ভালো হয়ে যা
আপুসোনা,
আজ তোর অপারেশন ছিল। আমি তোর অপারেশনের আগে ঠিকমত সময়ে ফোন দিতে পারিনি। কিভাবে পারব বল আমি তো জানতাম না যে আজই তোর অপারেশন হয়ে যাবে। তুই না আমাকে বলেছিলি ১৮ তারিখে হবে। তোর কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই যখন তোকে ফোন দিলাম তখন শুনলাম তুই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়েছিস। আমার এত খারাপ লাগছিল প্রায় কান্না চলে এসেছিল। শুনলাম অপারেশন এক ঘন্টা পরেই শেষ হয়ে যাবে আর তারও দুই ঘন্টা পরে তোর সাথে কথা বলা যাবে। আমার তখন ১২টা বেজে গেছে। ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়ি সকালে উঠে কথা বলব কিন্তু তোকে অপারেশনের টেবিলে রেখে আমার কি ঘুম আসার কথা বল? আসেওনি। এপাশ ওপাশ করে অবশেষে তোকে ফোন দিলাম। তোর গলা এত দুর্বল শোনাচ্ছিল কেনরে আপুসোনা আমার। অনেক কষ্ট দিয়েছে ডাক্তার গুলা তোকে? তোর কি এখনো ব্যাথা করছে শরীরে। এনেসথেসিয়া এখনো কাটেনি ভাল করে ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে তোর গলা তাও তুই কত মিষ্টি করে ডাকলি আমাকে পিচ্চি। নিজের অপারেশনের পরও তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস আমার অপারেশন কবে। তাই অবশ্য করার কথা আমরা দুজন ঠিক করেছিলাম নিজেদের অপারেশনের সময় অন্য জনের কথা ভাবব তাহলে আর নিজেদের কষ্টটা মনে পড়বে না। তোর সাথে কথা বলার পর ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু এরপর থেকে আর ঘুম আসছে না শুধু তোর গলা কানে বাজছে। এমন দুর্বল গলা তোর আর কখনো শুনিনি। এত তাড়াতাড়িও আর কখনো ফোন রাখিনি। কখন সকাল হবে কখন আবার তোকে ফোন দিয়ে শুনব পিচ্চিসোনা আমি এখন ভাল হয়ে গেছি তুই চিন্তা করিস না। তোর হাসিটা শুনব।
আপুসোনা সবসময় জানি তোকে আমি অনেক ভালবাসি কিন্তু আজ যখন তোর অপারেশন হচ্ছে ভাবতে ভাবতে চোখে পানি চলে আসল তখন বুঝলাম আমার আপুসোনাটা আমার কত আপন। তুই তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠ আপুসোনা তুই ভাল না হয়ে উঠলে আমার অপারেশন এর সময় কে আমাকে সাহস দিবে। খুব তাড়াতাড়ি আপুসোনা, অনেক অনেক মিস করছি তোকে আমার জাআআন আপ্পি।
তোর পিচ্চিসোনা
২০০৯-০৬-১৮
রাত তিনটা
আজ তোর অপারেশন ছিল। আমি তোর অপারেশনের আগে ঠিকমত সময়ে ফোন দিতে পারিনি। কিভাবে পারব বল আমি তো জানতাম না যে আজই তোর অপারেশন হয়ে যাবে। তুই না আমাকে বলেছিলি ১৮ তারিখে হবে। তোর কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই যখন তোকে ফোন দিলাম তখন শুনলাম তুই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়েছিস। আমার এত খারাপ লাগছিল প্রায় কান্না চলে এসেছিল। শুনলাম অপারেশন এক ঘন্টা পরেই শেষ হয়ে যাবে আর তারও দুই ঘন্টা পরে তোর সাথে কথা বলা যাবে। আমার তখন ১২টা বেজে গেছে। ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়ি সকালে উঠে কথা বলব কিন্তু তোকে অপারেশনের টেবিলে রেখে আমার কি ঘুম আসার কথা বল? আসেওনি। এপাশ ওপাশ করে অবশেষে তোকে ফোন দিলাম। তোর গলা এত দুর্বল শোনাচ্ছিল কেনরে আপুসোনা আমার। অনেক কষ্ট দিয়েছে ডাক্তার গুলা তোকে? তোর কি এখনো ব্যাথা করছে শরীরে। এনেসথেসিয়া এখনো কাটেনি ভাল করে ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে তোর গলা তাও তুই কত মিষ্টি করে ডাকলি আমাকে পিচ্চি। নিজের অপারেশনের পরও তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস আমার অপারেশন কবে। তাই অবশ্য করার কথা আমরা দুজন ঠিক করেছিলাম নিজেদের অপারেশনের সময় অন্য জনের কথা ভাবব তাহলে আর নিজেদের কষ্টটা মনে পড়বে না। তোর সাথে কথা বলার পর ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু এরপর থেকে আর ঘুম আসছে না শুধু তোর গলা কানে বাজছে। এমন দুর্বল গলা তোর আর কখনো শুনিনি। এত তাড়াতাড়িও আর কখনো ফোন রাখিনি। কখন সকাল হবে কখন আবার তোকে ফোন দিয়ে শুনব পিচ্চিসোনা আমি এখন ভাল হয়ে গেছি তুই চিন্তা করিস না। তোর হাসিটা শুনব।
আপুসোনা সবসময় জানি তোকে আমি অনেক ভালবাসি কিন্তু আজ যখন তোর অপারেশন হচ্ছে ভাবতে ভাবতে চোখে পানি চলে আসল তখন বুঝলাম আমার আপুসোনাটা আমার কত আপন। তুই তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠ আপুসোনা তুই ভাল না হয়ে উঠলে আমার অপারেশন এর সময় কে আমাকে সাহস দিবে। খুব তাড়াতাড়ি আপুসোনা, অনেক অনেক মিস করছি তোকে আমার জাআআন আপ্পি।
তোর পিচ্চিসোনা
২০০৯-০৬-১৮
রাত তিনটা
Friday, June 12, 2009
স্বপ্নেরা মর্ত্যে নেমে আসে
বৃহঃ, ২১/০৫/০৯ – ১২:০৫ অপরাহ্ন
আকাশের উপরে ভিত্তিহীন ভাবে ভেসে থাকা স্বপ্নেরা হুড়মুড় করে মর্ত্যে নেমে আসে। অতিকষ্টে আকাশের পরে আজন্ম দুলতে থাকা সংশয়পূর্ণ স্বপ্নেরা সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে শাসন না মেনে ফিরতে না চাওয়া দুষ্ট ছেলের মত, লুটোপুটি খায় কাঁদামাটিতে। আমি চেয়ে চেয়ে ওদের ভূলুণ্ঠিত উচ্ছল চেহারা দেখে ভাবি কিভাবে এতদিন ওরা এত উপরে ছিল। হর্ষধ্বনিতে উন্মাতাল এই পতন দেখে শঙ্কিত আমি বিষ্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকি আমার আশৈশব লালিত স্বপ্নগুলোর দিকে। মাটির সাথে মিশে যাওয়া উদ্দাম নৃত্যরত তাদের দিকে তাকিয়ে আমি চিনতে পারি প্রত্যেককে আলাদা করে। অনেক বড় হয়ে আকাশের সাথে মাথা ঠেকাবার উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন, অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ এই পঙ্কিল সমাজকে এক নিমিষে বদলে দেওয়ার সরল স্বপ্ন, অভিমানী মুহূর্তে পাখির মত ডানা মেলে অনেক দূরে সরে যাওয়ার ছেলেমানুষী স্বপ্ন, কোন এক দুর্বল মুহূর্তে দেখা ন্যায়-অন্যায় ভুলে যাবার অন্যায় স্বপ্ন, স্বপ্নালু সময়ে কাউকে কাছে পাবার স্বপ্ন সবাই আমাকে ভেংচি কাটে, খিলখিল করে হাসে আমার অসহায় অবস্থা দেখে।
আমি তাকিয়েই থাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার দৃষ্টির শঙ্কা, অসহায় ভাব পরিবর্তন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে সেখানে খেলা করে স্বস্তি। উর্ধ্বপানে তাকিয়ে দেখি তারা ঝলমলে আকাশ, চাঁদ আর চাঁদোয়ার সহাবস্থান। বহুদিন আমার আর এই সৌন্দর্য্যের মাঝে বাধা হয়ে ছিল যারা তারা আমার সামনে হুটোপুটি করে খেলা করছে। আমি আরেকবার সৌন্দর্য্য উপভোগ করে নেই এরপর যোগ দেই নৃত্যরত ভূলুন্ঠিত স্বপ্নদের সাথে। চীৎকার করে হাসি, দুহাত মেলে দিয়ে আলিঙ্গন করি মুক্তির আনন্দে। আজন্ম স্বপ্নের চাপে পিষ্ট হওয়া এই ছাপোষা আমি আজ মুক্তপুরুষ।
আকাশের উপরে ভিত্তিহীন ভাবে ভেসে থাকা স্বপ্নেরা হুড়মুড় করে মর্ত্যে নেমে আসে। অতিকষ্টে আকাশের পরে আজন্ম দুলতে থাকা সংশয়পূর্ণ স্বপ্নেরা সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে শাসন না মেনে ফিরতে না চাওয়া দুষ্ট ছেলের মত, লুটোপুটি খায় কাঁদামাটিতে। আমি চেয়ে চেয়ে ওদের ভূলুণ্ঠিত উচ্ছল চেহারা দেখে ভাবি কিভাবে এতদিন ওরা এত উপরে ছিল। হর্ষধ্বনিতে উন্মাতাল এই পতন দেখে শঙ্কিত আমি বিষ্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকি আমার আশৈশব লালিত স্বপ্নগুলোর দিকে। মাটির সাথে মিশে যাওয়া উদ্দাম নৃত্যরত তাদের দিকে তাকিয়ে আমি চিনতে পারি প্রত্যেককে আলাদা করে। অনেক বড় হয়ে আকাশের সাথে মাথা ঠেকাবার উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন, অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ এই পঙ্কিল সমাজকে এক নিমিষে বদলে দেওয়ার সরল স্বপ্ন, অভিমানী মুহূর্তে পাখির মত ডানা মেলে অনেক দূরে সরে যাওয়ার ছেলেমানুষী স্বপ্ন, কোন এক দুর্বল মুহূর্তে দেখা ন্যায়-অন্যায় ভুলে যাবার অন্যায় স্বপ্ন, স্বপ্নালু সময়ে কাউকে কাছে পাবার স্বপ্ন সবাই আমাকে ভেংচি কাটে, খিলখিল করে হাসে আমার অসহায় অবস্থা দেখে।
আমি তাকিয়েই থাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার দৃষ্টির শঙ্কা, অসহায় ভাব পরিবর্তন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে সেখানে খেলা করে স্বস্তি। উর্ধ্বপানে তাকিয়ে দেখি তারা ঝলমলে আকাশ, চাঁদ আর চাঁদোয়ার সহাবস্থান। বহুদিন আমার আর এই সৌন্দর্য্যের মাঝে বাধা হয়ে ছিল যারা তারা আমার সামনে হুটোপুটি করে খেলা করছে। আমি আরেকবার সৌন্দর্য্য উপভোগ করে নেই এরপর যোগ দেই নৃত্যরত ভূলুন্ঠিত স্বপ্নদের সাথে। চীৎকার করে হাসি, দুহাত মেলে দিয়ে আলিঙ্গন করি মুক্তির আনন্দে। আজন্ম স্বপ্নের চাপে পিষ্ট হওয়া এই ছাপোষা আমি আজ মুক্তপুরুষ।
Friday, June 5, 2009
আমার আপুসোনা - ৫
ক্রিংক্রিংক্রিং………
ধুর ঘুমের মধ্যে রিং ভাল লাগে না। কানের উপর বালিশ দিয়ে আবার ঘুমাবার ট্রাই নিলাম। কিন্তু কে যে এই ফোনটা দিচ্ছে তার কোন বিরক্তি নেই। বালিশ সরিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে আগে ঘড়ি দেখলাম। ৮টা বাজে ইশশ ভার্সিটি বন্ধের এই সময়গুলাতে একদিনও আমি ১২টার আগে উঠিনি। এতক্ষণে আমার কলার এর নাম নজরে পড়ল।
-আরে আপুসোনা তুই?
-কিরে ঘুমাচ্ছিস নিশ্চয়ই। তোর ঘুম ভাঙ্গালাম এজন্য স্যরি।
-ধুর কি যে বলিস আপুসোনা। বিয়ের আগে তো সবসময় আমার ঘুম তুইই ভাঙ্গাতিস। কতদিন আসিস না বাসায়। তোর জামাইটাকে পাইলে আমি এমন মাইর দিতাম।
-হাহাহা, কেনরে আমার জামাই তোর কি ক্ষতি করল।
-না ক্ষতি করবে কেন। এমনি ওনার উপর আমার রাগ। আমার আপুসোনাকে আমার থেকে নিয়ে গেল এই জন্য। কেমন আছেরে ভাইয়া?
-আছে অনেক ভাল আছে। কাল আমরা হেভভি মজা করলাম।
-কি মজা করলি?
-সেটা ফোনে নয় সামনাসামনি বলব।
-তুই আসবি আজ বাসায়? ওয়াও এক্ষুণি চলে আয় আপুসোনা। আমার বন্ধ আছে। আসলে কিন্তু ২-৩ দিন থাকতে হবে।
-নারে আসব না।
-আসবি না? তুই খুব খারাপ একটুও আমার কথা, আম্মুর কথা মনে পড়ে না। কতদিন আসিস না।
-কিরে সেদিন না আসলাম।
-২ সপ্তাহ হয়েছে, আসছিস কিন্তু থাকিস তো না। তোর তো বাবু হয়নি এখন কি এত সংসার। ঘুরবি ফিরবি…
-হাহাহা , তুই এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছিস।
- তোর সাথে কেন যে আমি কথা বলি এখনো , তোর উপর আমার কত রাগ তুই জানিস? তোকে যে আমি দুদিন আগে তোর জন্মদিনে চিঠি লেখলাম একটু বললি ও না চিঠি পেয়ে কেমন লাগল।
- ঐ তোকে না আমি সাথে সাথে এসএমএস করে জানালাম যে তোর চিঠি পেয়েছি, খুশি হয়েছি।
-ব্যাস এটুকু? চিঠির উত্তর তো চাইনি বাবা জাস্ট চিঠি পেয়ে একটা বড় মেসেজ দিয়ে বলবি পিচ্চিসোনা তোর চিঠি পাইছি খুব ভাল লাগছে , তুই আমাকে এত ভালবাসিস জেনে চোখে পানি চলে এসেছে……, আমিও তোকে অনেক ভালবাসি হ্যান ত্যান তা না ১ লাইনের একটা এসএমএস। আমার চিঠি লেখাটাই ভুল হইছে তোকে।
-ওরে বাবা আমার পিচ্চিটার দেখি অনেক রাগ হইছে আমার উপর। সেদিন অফিসে কাজ ছিলরে বাবুয়া। আজ তোর রাগ ভাঙাব আয়। আজ আমি অফিসে যাই নি। ইচ্ছে হচ্ছিল না। পেপার খুলে দেখলাম শেরাটনে ঈগলু ফেস্টিভাল চলছে। তুই এসে আমাকে নিয়ে যা। আজ সারাদিন তোর সাথে ঘুরব।
-ওয়াও। তাই নাকি দাড়া আমি এখনই রেডি হয়ে আসছি তোকে নিতে।
-দাঁড়া দাঁড়া, এখনি আসিস না। আমি গাড়ি নিয়ে বের হব। গাড়িটা তোর ভাইয়াকে নামিয়ে দিয়ে আসুক। এরপর। তুই ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হ।
-যো হুকুম আপুসোনা।
-ওহহ শোন , তোর কি রাতে কোন কাজ আছে?
-থাকলেও এখন নাই হয়ে গেল। তোর জন্য আমার সব কিছু বাদ।
-তাহলে আইসক্রিম খেয়ে একটু শপিং এ যাব। সেখান থেকে রাতে চাইনিজ খেয়ে বাসায় ফিরব।
- এই আপুসোনা তোকে একটা রিকোয়েস্ট করি?
-নাহ তোর রিকোয়েস্ট রাখতে পারব না।
-কি রিকোয়েস্ট করব না শুনেই।
- আমি জানি তুই কি বলবি। রাতে বাসায় চলে আয় না আপুসোনা। কালকে তো শুক্রবার।
-তুই কিভাবে আমার কথা আগে থেকে বুঝে যাস আপুসোনা।
-কারণ তুই তো ভাবিস তুইই শুধু আমাকে ভালবাসিস। আমি বাসি না।
-বাসলে কি আর আমার কথাটা ফেলতি। আম্মুও কিন্তু বলছিল অনেকদিন তুই আমাদের বাসায় থাকিস না।
- নারে ভাইয়া কাল তোর ভাইয়ার সাথে একটা পিকনিকে যেতে হবে। আমার যদিও কোন ইচ্ছে নাই তাও ও শখ করেছে না গেলে কেমন হয় তাই না। রবিবার দিন এসে আম্মুর সাথে দেখা করে যাব।
-ঠিক আছে কি আর করব। চাইনিজ কি তুই খাওয়াবি? নাকি আমি মানিব্যাগ নিয়ে বের হব।
-বড় হইছিস মনে হয়?
- আরে না পার্ট নিলাম। গতকাল স্কলারশীপের টাকা পাইছি। শপিং এ যখন যাবি তাহলে ভালই হল, আম্মুর জন্য একটা শাড়ি কিনব আর তোর জন্য কিছু একটা যেটা তোর পছন্দ হয়। আমি অবশ্য শাড়িই প্রেফার করব কিন্তু তোর যেটা খুশি।
- তুই প্রতিবার স্কলারশীপ পেলেই আমাকে শাড়ি দেস। আমার তো লাগবে না ভাইয়া। গত ঈদেই তো একটা দিলি।
-প্রতিবার দেই এইবার কেন বাদ যাবে?
-ওক্কে পাগলা।
-তুই কি কিনবি?
- আমার দেবরের জন্য একটা শার্ট কিনব।
-কেন?
-ওর জন্মদিন সামনে। গিফট।
-কেন??? তোমার দেবরের জন্য তোমার মায়া বেশি। আমার একটুও সহ্য হয় না। কেন তাকে গিফট দিতে হবে। ভাইয়াকে বল উনি দিবে তুমি কেন।
-ঐ শয়তান। কি বলিস তুই? তোর ভাইয়া তো তকে জন্মদিনে গিফট দে তাহলে ঐটা কি?
- তা জানিনা তুই অন্য কাউকে আদর করলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়। আমার আদরের ভাগ কমে যায় বলে মনে হয়।
-তুই একটা আস্ত পাগল আছিস। কবে যে তুই বড় হবি?
-কেন বড় যে হতেই হবে এমন কোন কথা আছে?
-আছে না। তোকে বিয়ে দিব তো। বাসায় একটা বউ আনব না।
- আসলেই দিবি? কবে দিবি বল । আমি তো শুধু তোর কাছেই বাচ্চামি করি। অন্য সব জায়গায় আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।
-ইশশ বিয়ের কত শখ? তোকে এখন মেয়ে কে দিবে।
-দরকার নাই তাহলে বিয়ে করার পরেই করি কি বলিস।
- এই তুই খালি কি কথা বলতেই থাকবি? তোর ভাইয়া অফিসে যাবে গুছিয়ে দেই। আমার ও তো রেডি হতে হবে। আজ সারাদিন ভাই বোনে অনেক কথা বলব । অনেকদিনের অনেক কথা জমে আছে ।
- ওক্কেরে আমার জাআআন আপ্পি রাখছি। আমি এখনই চলে আসছি তোর বাসায়। একসাথেই বের হব। তুই আমার জন্য নাস্তা বানা। তোর বাসায় এসে নাস্তা খাব। আম্মু নিশ্চয়ই এখনো আমার জন্য নাস্তা বানায় নাই আমি তো প্রতিদিন ১২টায় ঘুম থেকে উঠছি এখন। তুই ঘুম থেকে জাগালি তুইই নাস্তা খাওয়া।
-চলে আয়, কি খাবি বল?
-তুই যদি ছোটবেলার মত খাওয়ায় দেস তাহলে যা দিবি তাই ।
-পাগল ভাই আমার।
-রাখলাম রে আপু। খুব খুশি লাগছে অনেকদিন পর তোর সাথে আজ সারাদিন ঘুরব।
-ওক্কে বাই ডিয়ার।
ধুর ঘুমের মধ্যে রিং ভাল লাগে না। কানের উপর বালিশ দিয়ে আবার ঘুমাবার ট্রাই নিলাম। কিন্তু কে যে এই ফোনটা দিচ্ছে তার কোন বিরক্তি নেই। বালিশ সরিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে আগে ঘড়ি দেখলাম। ৮টা বাজে ইশশ ভার্সিটি বন্ধের এই সময়গুলাতে একদিনও আমি ১২টার আগে উঠিনি। এতক্ষণে আমার কলার এর নাম নজরে পড়ল।
-আরে আপুসোনা তুই?
-কিরে ঘুমাচ্ছিস নিশ্চয়ই। তোর ঘুম ভাঙ্গালাম এজন্য স্যরি।
-ধুর কি যে বলিস আপুসোনা। বিয়ের আগে তো সবসময় আমার ঘুম তুইই ভাঙ্গাতিস। কতদিন আসিস না বাসায়। তোর জামাইটাকে পাইলে আমি এমন মাইর দিতাম।
-হাহাহা, কেনরে আমার জামাই তোর কি ক্ষতি করল।
-না ক্ষতি করবে কেন। এমনি ওনার উপর আমার রাগ। আমার আপুসোনাকে আমার থেকে নিয়ে গেল এই জন্য। কেমন আছেরে ভাইয়া?
-আছে অনেক ভাল আছে। কাল আমরা হেভভি মজা করলাম।
-কি মজা করলি?
-সেটা ফোনে নয় সামনাসামনি বলব।
-তুই আসবি আজ বাসায়? ওয়াও এক্ষুণি চলে আয় আপুসোনা। আমার বন্ধ আছে। আসলে কিন্তু ২-৩ দিন থাকতে হবে।
-নারে আসব না।
-আসবি না? তুই খুব খারাপ একটুও আমার কথা, আম্মুর কথা মনে পড়ে না। কতদিন আসিস না।
-কিরে সেদিন না আসলাম।
-২ সপ্তাহ হয়েছে, আসছিস কিন্তু থাকিস তো না। তোর তো বাবু হয়নি এখন কি এত সংসার। ঘুরবি ফিরবি…
-হাহাহা , তুই এখনো বাচ্চাই রয়ে গেছিস।
- তোর সাথে কেন যে আমি কথা বলি এখনো , তোর উপর আমার কত রাগ তুই জানিস? তোকে যে আমি দুদিন আগে তোর জন্মদিনে চিঠি লেখলাম একটু বললি ও না চিঠি পেয়ে কেমন লাগল।
- ঐ তোকে না আমি সাথে সাথে এসএমএস করে জানালাম যে তোর চিঠি পেয়েছি, খুশি হয়েছি।
-ব্যাস এটুকু? চিঠির উত্তর তো চাইনি বাবা জাস্ট চিঠি পেয়ে একটা বড় মেসেজ দিয়ে বলবি পিচ্চিসোনা তোর চিঠি পাইছি খুব ভাল লাগছে , তুই আমাকে এত ভালবাসিস জেনে চোখে পানি চলে এসেছে……, আমিও তোকে অনেক ভালবাসি হ্যান ত্যান তা না ১ লাইনের একটা এসএমএস। আমার চিঠি লেখাটাই ভুল হইছে তোকে।
-ওরে বাবা আমার পিচ্চিটার দেখি অনেক রাগ হইছে আমার উপর। সেদিন অফিসে কাজ ছিলরে বাবুয়া। আজ তোর রাগ ভাঙাব আয়। আজ আমি অফিসে যাই নি। ইচ্ছে হচ্ছিল না। পেপার খুলে দেখলাম শেরাটনে ঈগলু ফেস্টিভাল চলছে। তুই এসে আমাকে নিয়ে যা। আজ সারাদিন তোর সাথে ঘুরব।
-ওয়াও। তাই নাকি দাড়া আমি এখনই রেডি হয়ে আসছি তোকে নিতে।
-দাঁড়া দাঁড়া, এখনি আসিস না। আমি গাড়ি নিয়ে বের হব। গাড়িটা তোর ভাইয়াকে নামিয়ে দিয়ে আসুক। এরপর। তুই ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হ।
-যো হুকুম আপুসোনা।
-ওহহ শোন , তোর কি রাতে কোন কাজ আছে?
-থাকলেও এখন নাই হয়ে গেল। তোর জন্য আমার সব কিছু বাদ।
-তাহলে আইসক্রিম খেয়ে একটু শপিং এ যাব। সেখান থেকে রাতে চাইনিজ খেয়ে বাসায় ফিরব।
- এই আপুসোনা তোকে একটা রিকোয়েস্ট করি?
-নাহ তোর রিকোয়েস্ট রাখতে পারব না।
-কি রিকোয়েস্ট করব না শুনেই।
- আমি জানি তুই কি বলবি। রাতে বাসায় চলে আয় না আপুসোনা। কালকে তো শুক্রবার।
-তুই কিভাবে আমার কথা আগে থেকে বুঝে যাস আপুসোনা।
-কারণ তুই তো ভাবিস তুইই শুধু আমাকে ভালবাসিস। আমি বাসি না।
-বাসলে কি আর আমার কথাটা ফেলতি। আম্মুও কিন্তু বলছিল অনেকদিন তুই আমাদের বাসায় থাকিস না।
- নারে ভাইয়া কাল তোর ভাইয়ার সাথে একটা পিকনিকে যেতে হবে। আমার যদিও কোন ইচ্ছে নাই তাও ও শখ করেছে না গেলে কেমন হয় তাই না। রবিবার দিন এসে আম্মুর সাথে দেখা করে যাব।
-ঠিক আছে কি আর করব। চাইনিজ কি তুই খাওয়াবি? নাকি আমি মানিব্যাগ নিয়ে বের হব।
-বড় হইছিস মনে হয়?
- আরে না পার্ট নিলাম। গতকাল স্কলারশীপের টাকা পাইছি। শপিং এ যখন যাবি তাহলে ভালই হল, আম্মুর জন্য একটা শাড়ি কিনব আর তোর জন্য কিছু একটা যেটা তোর পছন্দ হয়। আমি অবশ্য শাড়িই প্রেফার করব কিন্তু তোর যেটা খুশি।
- তুই প্রতিবার স্কলারশীপ পেলেই আমাকে শাড়ি দেস। আমার তো লাগবে না ভাইয়া। গত ঈদেই তো একটা দিলি।
-প্রতিবার দেই এইবার কেন বাদ যাবে?
-ওক্কে পাগলা।
-তুই কি কিনবি?
- আমার দেবরের জন্য একটা শার্ট কিনব।
-কেন?
-ওর জন্মদিন সামনে। গিফট।
-কেন??? তোমার দেবরের জন্য তোমার মায়া বেশি। আমার একটুও সহ্য হয় না। কেন তাকে গিফট দিতে হবে। ভাইয়াকে বল উনি দিবে তুমি কেন।
-ঐ শয়তান। কি বলিস তুই? তোর ভাইয়া তো তকে জন্মদিনে গিফট দে তাহলে ঐটা কি?
- তা জানিনা তুই অন্য কাউকে আদর করলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়। আমার আদরের ভাগ কমে যায় বলে মনে হয়।
-তুই একটা আস্ত পাগল আছিস। কবে যে তুই বড় হবি?
-কেন বড় যে হতেই হবে এমন কোন কথা আছে?
-আছে না। তোকে বিয়ে দিব তো। বাসায় একটা বউ আনব না।
- আসলেই দিবি? কবে দিবি বল । আমি তো শুধু তোর কাছেই বাচ্চামি করি। অন্য সব জায়গায় আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।
-ইশশ বিয়ের কত শখ? তোকে এখন মেয়ে কে দিবে।
-দরকার নাই তাহলে বিয়ে করার পরেই করি কি বলিস।
- এই তুই খালি কি কথা বলতেই থাকবি? তোর ভাইয়া অফিসে যাবে গুছিয়ে দেই। আমার ও তো রেডি হতে হবে। আজ সারাদিন ভাই বোনে অনেক কথা বলব । অনেকদিনের অনেক কথা জমে আছে ।
- ওক্কেরে আমার জাআআন আপ্পি রাখছি। আমি এখনই চলে আসছি তোর বাসায়। একসাথেই বের হব। তুই আমার জন্য নাস্তা বানা। তোর বাসায় এসে নাস্তা খাব। আম্মু নিশ্চয়ই এখনো আমার জন্য নাস্তা বানায় নাই আমি তো প্রতিদিন ১২টায় ঘুম থেকে উঠছি এখন। তুই ঘুম থেকে জাগালি তুইই নাস্তা খাওয়া।
-চলে আয়, কি খাবি বল?
-তুই যদি ছোটবেলার মত খাওয়ায় দেস তাহলে যা দিবি তাই ।
-পাগল ভাই আমার।
-রাখলাম রে আপু। খুব খুশি লাগছে অনেকদিন পর তোর সাথে আজ সারাদিন ঘুরব।
-ওক্কে বাই ডিয়ার।
Monday, June 1, 2009
অভিমান
আমি এবার বদলে যাব
কাউকে আর চাইব না,
কাউকে ভাল বাসব না,
আমাকেও বাসবে না কেউ।
আমি এবার বদলে যাব।
আর কখনো হাসব না,
ব্যাথা পেলেও কাঁদব না,
ইচ্ছে হলেও ডাকব না,
কারো একটু ডাকের আশায়
পেছন দিকে চাইব না।
আমি এবার বদলে যাব।
-------শনি, ১৬/০৫/০৯
কাউকে আর চাইব না,
কাউকে ভাল বাসব না,
আমাকেও বাসবে না কেউ।
আমি এবার বদলে যাব।
আর কখনো হাসব না,
ব্যাথা পেলেও কাঁদব না,
ইচ্ছে হলেও ডাকব না,
কারো একটু ডাকের আশায়
পেছন দিকে চাইব না।
আমি এবার বদলে যাব।
-------শনি, ১৬/০৫/০৯
Friday, May 8, 2009
আয় আরেকটি বার আয়রে সখা, প্রাণের মাঝে (০১)
১।
কলেজের দ্বিতীয় দিনেই ফুটবল খেলতে গিয়ে নিজেকে জাহির করার তাগিদ অনুভব করলাম আমি। প্রথম দিনেই সবার দৃষ্টি কাড়তে হবে এমন একটা ভাব নিয়ে ২১-২১ জনে খেলা এ ফর্ম, বি ফর্ম খেলার মাঝেই আমি প্রচুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলাম। ২১ জনের মধ্যে আগের দিনের বৃষ্টিতে কাঁদামাখা সেই মাঠে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে তোলা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। সবার প্রথমে সবাই স্ট্রাইকার হতে চায়, দ্বিতীয়ত যেখানেই বল যায় সেখানেই সবাই হাজির হয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ঠিক তখনই ডি বক্সের সামনে উলটা অবস্থায় বল পেয়ে আমি এইটাকেই শেষ চান্স ভেবে ব্যাকভলি করার জন্য লাফ দিলাম। পায়ে বল লেগেছিল কিনা গোল হয়েছিল কিনা আজ আর মনে নেই। সেদিন গোল দিতে পেরেছি বলে মনে পড়ছে না কিন্তু ঠিকই সবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিনই আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল সকাল বেলা নিজের হাতকে আর হাত মনে হচ্ছিল না। সেই ব্যাকভলি দিয়ে হাত ফুলে গিয়েছিল। এরপর পাক্কা দেড় মাস হাসপাতালে ছিলাম হাতে প্লাস্টার নিয়ে। সবাই জানত ওদের একটা ক্লাসমেট আছে নাম ও মনে হয় জানত না যে কিনা হাসপাতালে থাকে। ২ সপ্তাহ পরে অবশ্য প্লাস্টার জড়ানো হাত নিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম। হাসপাতালে থাকার কারণে অনেকদিন পর্যন্ত আমি আমার হাউসের সবার নাম ও জানতাম না। নিজের ফর্মের পোলাপানদের চিনতাম শুধু। তাই আমার সাথে সবার চেনাজানা একটু দেরিতেই হয়েছিল।
২
হাসপাতালে থাকতেই জাহিদের সাথে পরিচয়। কোন একদিন ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল । কলেজের খাবার খেতে পারেনা। বেশ কয়েকবার বমি করেছে। হাসপাতালে আসাতে আমি পুরান রোগী হিসেবে ক্লাসমেটকে বরণ করলাম। কিন্তু সেখানে তেমন কিছু অন্তরঙ্গতা হল না। আমার আগেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেল। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব শুরু হল বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে। তখন আমাদের নভিসেস প্যারেড শেষ আমরাও কলেজের ক্যাডেট হয়ে গেছি। বাস্কেটবল নতুন খেলা দেখে আমরা বেশ কসরত করে সেটা শেখার চেষ্টা করি। তার মধ্যে আমি আর জাহিদ ও আছি। যারা আমাদের শেখায় তারাও খুব যে পারে তা না ওরা একটু লম্বা এই জন্যই বল নিয়ে কিসব করে দেখায় আমাদের। আমরা হা হয়ে তাকিয়ে থাকি। কখন থেকে যে আমরা একেবারে টিম হয়ে খেলা শুরু করে দিলাম মনে নেই। তবে জাহিদের সাথে আমার মনে পড়ে না আমি আর ও কোনদিন এক দলে ছিলাম। কেমন করে খেলতে খেলতে আমরা দুজনই একই পর্যায়ের খেলোয়াড় হয়ে গেলাম। যার কারণে দল ভাগ করার সময় প্রথমেই আমাদের দুজনকে দুদিকে দিয়ে দেওয়া হত। আমরাও সেই দুই দলের হয়ে প্রতিদিন খেলার মাঝে এবং আগে পরে গলা ফাটিয়ে নিজেদের মাঝে ঝগড়া করতাম। ক্লাস ৮ পর্যন্ত আমি আর জাহিদ প্রায়ই খেলার মাঝে একে অপরের সাথে লাগালাগি করেছি। সেই ঝগড়াই আমাদের কাছে এনে দিয়েছে। খেলা শেষে প্রতিদিন একসাথে আবার হাউসে ফিরতাম। পরেরদিন আবার ঝগড়া। একসময় দেখলাম আমরা শুধু খেলার সময়টুকুই আলাদা থাকি।
৩।
পরীক্ষার সময় ও আমাদের আগে পরে বসা নিয়ম হয়ে গেল। কেমন কেমন করে যেন ও আমার আগে পিছে কিংবা কোনাকোনি থাকতই। আর আমরা ২ জন এক সিট ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকলে আর কিছু লাগত না। ফর্মের মাঝে হয়েছে এমন খুব কম পরীক্ষাই ছিল যেটাতে আমাদের দুজনের অবজেক্টিভ এর মার্কস আলাদা আসত। তাই ওকে শুধু সাবজেকটিভ দিয়ে পিছনে ফেলতে খুবই কষ্ট হত। ওকে নিয়েই ভয় পেতাম এই বুঝি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিল আমার পজিশন থেকে। কিন্তু কি একটা অবহেলা ছিল ওর মাঝে। এমন ভাব আমি পারি কিন্তু করব না। কখনোই পড়ালেখায় সেইরকম সময় দেয়নি ও। এসএসসি পরীক্ষার পর আমাকে বলেছিল তুই ও ফার্স্ট হবার মত পড়িস নি আমিও না। তাই আফসোস নাই। সেদিন মনে মনে বলেছিলাম এবার পড়ব। কিন্তু ওর মনে হয় এইসব খুব একটা কিছু এসে যেত না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট এর পর আমরা অনেকেই যখন রাত জাগি, কেউ পড়ার ভান কেউ বা বই নিয়ে গার্ডদের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করে কাটাত কখন ডাব পাড়তে যাবে কিংবা সিগারেট খাবে তখন তার অর্ধেক ঘুম পার হয়ে গেছে। ওর রুমমেট অন্য রুমে গিয়ে সময় কাটাত যাতে ওর ঘুমের সমস্যা না হয়। আমাদের আরেক বন্ধুর আফসোসই ছিল যে হাউসের সবাইকে ডাব খাইয়েছি শুধু জাহিদ ছাড়া। তারপরও রেজাল্ট বের হবার পর দেখা গেল মেরিট লিস্টে খুব ভাল পজিশনে ও। আমি শুধু ভাবি ভাগ্যিস ও আমাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়নি কখনো।
৪।
কার্ড খেলতাম আমরা খুব। সেই ক্লাস ১১ থেকে ২৯ খেলতাম পাগলের মত। ছুটিতে এসে কত রাত যে পার করে দিয়েছি শুধু কার্ড খেলে তার গুনতি নেই। বুয়েটে ঢুকেও ডেল ক্যাফেতে বসে বসে শুধু কার্ডই খেলতাম ( আমাদের জন্যই কিনা ডেল ক্যাফে পরে বন্ধ করে দিল কোন অনুষ্ঠান ছাড়া ঢোকা যেত না। এখন কি অবস্থা কে জানে) । বুয়েটে এসে আমাদের উন্নতি হল আমরা ব্রিজ খেলা শিখলাম। কত ক্লাস যে বাং মেরেছি কার্ড খেলার জন্য। জাহিদের কার্ড খেলার স্টাইল যেই ওর সাথে খেলেছে মনে থাকবে নিশ্চয়ই। এমন ভাব ধরত যেন সমস্ত ভাল কার্ড ওর কাছেই। এমন ভাবে কল দিত যেন তোলা কোন ব্যাপারই না। খেলা হারার পর ও এমন ভাব মনে হত ওর মন ছিল না খেলায় নইলে ওকে হারাতে পারে এমন কেউ আছে নাকি। গুড প্লেয়ার আর ভাল খেলোয়াড় এই দুইটার একটা পার্থক্য ছিল আমাদের মাঝে। যে ভাল কার্ড পায় তারপর খেলা তুলে সে গুড প্লেয়ার আর যে কিছু না পেয়েও মাথা খাটিয়ে খেলে সে খেলা তুলতে না পারলেও ভাল খেলোয়াড়। নিজেকে ভাল খেলোয়াড় দাবি করে আসল জাহিদ আজীবন। ওর সাথে কার্ড খেলা খুবই মিস করি। এখন আর খেলে না ও। সেদিন প্রায় ৫ বছর পর এক রাত ওর সাথে কার্ড খেললাম। জীবনেও ভাবি নাই আর কখনো জাহিদের সাথে কার্ড খেলব।
৫।
৯৬ থেকে ২০০৯ আজ ১৩ বছর আমি আর জাহিদ একসাথে। কলেজ থেকে বের হয়ে একসাথে বুয়েট কোচিং করে বুয়েটে একসাথে প্রতিটা দিন আড্ডা দিয়ে একইসাথে জাপানে পাড়ি দিয়েছি আমরা। মাঝে ৩ বছর দুজন দুইটা ইন্সটিটিউশনে ছিলাম এখন আবার একসাথে। আমার পাশের বিল্ডিং এই থাকে (অবশ্য বউ নিয়ে … ) । বন্ধু হিসেবে জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি ওর সাথে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাব প্রকাশে এখন মনে হয় আর আমাদের কথা বলার ও দরকার হয় না। এই লম্বা সময়ে যে ওর সাথে রাগ করিনাই এমন না। অনেক বার ওর অনেক কাজে ক্ষেপে গিয়েছি ভেবেছি আর কখনো কথাই বলব না, কখনো বা ভেবেছি শালা মজাতেই আছে অনেক বদলে গেছে আমার আর এখন দরকার নেই কিন্তু কেমন করে যেন আবার ঠিক হয়ে গেছে তা আর মনে নেই। মনে আছে সর্বোচ্চ এক মাস ওর সাথে কথা না বলে থেকেছিলাম কলেজে ক্লাস ৯ এ থাকার সময়। কেন লেগেছিলাম তাও মনে আছে কিন্তু এখানে লেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এত ছেলেমানুষ ছিলাম সেটা আমার আর ওর মাঝেই থাক। ১৩ বছর অল্প সময় না। তাই আজ বন্ধুদের নিয়ে কিছু লেখতে গিয়ে ওর নামই প্রথমে মনে পড়ল।
ভাল থাকিস দোস্ত।
কলেজের দ্বিতীয় দিনেই ফুটবল খেলতে গিয়ে নিজেকে জাহির করার তাগিদ অনুভব করলাম আমি। প্রথম দিনেই সবার দৃষ্টি কাড়তে হবে এমন একটা ভাব নিয়ে ২১-২১ জনে খেলা এ ফর্ম, বি ফর্ম খেলার মাঝেই আমি প্রচুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলাম। ২১ জনের মধ্যে আগের দিনের বৃষ্টিতে কাঁদামাখা সেই মাঠে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে তোলা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। সবার প্রথমে সবাই স্ট্রাইকার হতে চায়, দ্বিতীয়ত যেখানেই বল যায় সেখানেই সবাই হাজির হয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ঠিক তখনই ডি বক্সের সামনে উলটা অবস্থায় বল পেয়ে আমি এইটাকেই শেষ চান্স ভেবে ব্যাকভলি করার জন্য লাফ দিলাম। পায়ে বল লেগেছিল কিনা গোল হয়েছিল কিনা আজ আর মনে নেই। সেদিন গোল দিতে পেরেছি বলে মনে পড়ছে না কিন্তু ঠিকই সবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিনই আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল সকাল বেলা নিজের হাতকে আর হাত মনে হচ্ছিল না। সেই ব্যাকভলি দিয়ে হাত ফুলে গিয়েছিল। এরপর পাক্কা দেড় মাস হাসপাতালে ছিলাম হাতে প্লাস্টার নিয়ে। সবাই জানত ওদের একটা ক্লাসমেট আছে নাম ও মনে হয় জানত না যে কিনা হাসপাতালে থাকে। ২ সপ্তাহ পরে অবশ্য প্লাস্টার জড়ানো হাত নিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম। হাসপাতালে থাকার কারণে অনেকদিন পর্যন্ত আমি আমার হাউসের সবার নাম ও জানতাম না। নিজের ফর্মের পোলাপানদের চিনতাম শুধু। তাই আমার সাথে সবার চেনাজানা একটু দেরিতেই হয়েছিল।
২
হাসপাতালে থাকতেই জাহিদের সাথে পরিচয়। কোন একদিন ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল । কলেজের খাবার খেতে পারেনা। বেশ কয়েকবার বমি করেছে। হাসপাতালে আসাতে আমি পুরান রোগী হিসেবে ক্লাসমেটকে বরণ করলাম। কিন্তু সেখানে তেমন কিছু অন্তরঙ্গতা হল না। আমার আগেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেল। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব শুরু হল বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে। তখন আমাদের নভিসেস প্যারেড শেষ আমরাও কলেজের ক্যাডেট হয়ে গেছি। বাস্কেটবল নতুন খেলা দেখে আমরা বেশ কসরত করে সেটা শেখার চেষ্টা করি। তার মধ্যে আমি আর জাহিদ ও আছি। যারা আমাদের শেখায় তারাও খুব যে পারে তা না ওরা একটু লম্বা এই জন্যই বল নিয়ে কিসব করে দেখায় আমাদের। আমরা হা হয়ে তাকিয়ে থাকি। কখন থেকে যে আমরা একেবারে টিম হয়ে খেলা শুরু করে দিলাম মনে নেই। তবে জাহিদের সাথে আমার মনে পড়ে না আমি আর ও কোনদিন এক দলে ছিলাম। কেমন করে খেলতে খেলতে আমরা দুজনই একই পর্যায়ের খেলোয়াড় হয়ে গেলাম। যার কারণে দল ভাগ করার সময় প্রথমেই আমাদের দুজনকে দুদিকে দিয়ে দেওয়া হত। আমরাও সেই দুই দলের হয়ে প্রতিদিন খেলার মাঝে এবং আগে পরে গলা ফাটিয়ে নিজেদের মাঝে ঝগড়া করতাম। ক্লাস ৮ পর্যন্ত আমি আর জাহিদ প্রায়ই খেলার মাঝে একে অপরের সাথে লাগালাগি করেছি। সেই ঝগড়াই আমাদের কাছে এনে দিয়েছে। খেলা শেষে প্রতিদিন একসাথে আবার হাউসে ফিরতাম। পরেরদিন আবার ঝগড়া। একসময় দেখলাম আমরা শুধু খেলার সময়টুকুই আলাদা থাকি।
৩।
পরীক্ষার সময় ও আমাদের আগে পরে বসা নিয়ম হয়ে গেল। কেমন কেমন করে যেন ও আমার আগে পিছে কিংবা কোনাকোনি থাকতই। আর আমরা ২ জন এক সিট ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকলে আর কিছু লাগত না। ফর্মের মাঝে হয়েছে এমন খুব কম পরীক্ষাই ছিল যেটাতে আমাদের দুজনের অবজেক্টিভ এর মার্কস আলাদা আসত। তাই ওকে শুধু সাবজেকটিভ দিয়ে পিছনে ফেলতে খুবই কষ্ট হত। ওকে নিয়েই ভয় পেতাম এই বুঝি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিল আমার পজিশন থেকে। কিন্তু কি একটা অবহেলা ছিল ওর মাঝে। এমন ভাব আমি পারি কিন্তু করব না। কখনোই পড়ালেখায় সেইরকম সময় দেয়নি ও। এসএসসি পরীক্ষার পর আমাকে বলেছিল তুই ও ফার্স্ট হবার মত পড়িস নি আমিও না। তাই আফসোস নাই। সেদিন মনে মনে বলেছিলাম এবার পড়ব। কিন্তু ওর মনে হয় এইসব খুব একটা কিছু এসে যেত না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট এর পর আমরা অনেকেই যখন রাত জাগি, কেউ পড়ার ভান কেউ বা বই নিয়ে গার্ডদের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করে কাটাত কখন ডাব পাড়তে যাবে কিংবা সিগারেট খাবে তখন তার অর্ধেক ঘুম পার হয়ে গেছে। ওর রুমমেট অন্য রুমে গিয়ে সময় কাটাত যাতে ওর ঘুমের সমস্যা না হয়। আমাদের আরেক বন্ধুর আফসোসই ছিল যে হাউসের সবাইকে ডাব খাইয়েছি শুধু জাহিদ ছাড়া। তারপরও রেজাল্ট বের হবার পর দেখা গেল মেরিট লিস্টে খুব ভাল পজিশনে ও। আমি শুধু ভাবি ভাগ্যিস ও আমাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়নি কখনো।
৪।
কার্ড খেলতাম আমরা খুব। সেই ক্লাস ১১ থেকে ২৯ খেলতাম পাগলের মত। ছুটিতে এসে কত রাত যে পার করে দিয়েছি শুধু কার্ড খেলে তার গুনতি নেই। বুয়েটে ঢুকেও ডেল ক্যাফেতে বসে বসে শুধু কার্ডই খেলতাম ( আমাদের জন্যই কিনা ডেল ক্যাফে পরে বন্ধ করে দিল কোন অনুষ্ঠান ছাড়া ঢোকা যেত না। এখন কি অবস্থা কে জানে) । বুয়েটে এসে আমাদের উন্নতি হল আমরা ব্রিজ খেলা শিখলাম। কত ক্লাস যে বাং মেরেছি কার্ড খেলার জন্য। জাহিদের কার্ড খেলার স্টাইল যেই ওর সাথে খেলেছে মনে থাকবে নিশ্চয়ই। এমন ভাব ধরত যেন সমস্ত ভাল কার্ড ওর কাছেই। এমন ভাবে কল দিত যেন তোলা কোন ব্যাপারই না। খেলা হারার পর ও এমন ভাব মনে হত ওর মন ছিল না খেলায় নইলে ওকে হারাতে পারে এমন কেউ আছে নাকি। গুড প্লেয়ার আর ভাল খেলোয়াড় এই দুইটার একটা পার্থক্য ছিল আমাদের মাঝে। যে ভাল কার্ড পায় তারপর খেলা তুলে সে গুড প্লেয়ার আর যে কিছু না পেয়েও মাথা খাটিয়ে খেলে সে খেলা তুলতে না পারলেও ভাল খেলোয়াড়। নিজেকে ভাল খেলোয়াড় দাবি করে আসল জাহিদ আজীবন। ওর সাথে কার্ড খেলা খুবই মিস করি। এখন আর খেলে না ও। সেদিন প্রায় ৫ বছর পর এক রাত ওর সাথে কার্ড খেললাম। জীবনেও ভাবি নাই আর কখনো জাহিদের সাথে কার্ড খেলব।
৫।
৯৬ থেকে ২০০৯ আজ ১৩ বছর আমি আর জাহিদ একসাথে। কলেজ থেকে বের হয়ে একসাথে বুয়েট কোচিং করে বুয়েটে একসাথে প্রতিটা দিন আড্ডা দিয়ে একইসাথে জাপানে পাড়ি দিয়েছি আমরা। মাঝে ৩ বছর দুজন দুইটা ইন্সটিটিউশনে ছিলাম এখন আবার একসাথে। আমার পাশের বিল্ডিং এই থাকে (অবশ্য বউ নিয়ে … ) । বন্ধু হিসেবে জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি ওর সাথে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাব প্রকাশে এখন মনে হয় আর আমাদের কথা বলার ও দরকার হয় না। এই লম্বা সময়ে যে ওর সাথে রাগ করিনাই এমন না। অনেক বার ওর অনেক কাজে ক্ষেপে গিয়েছি ভেবেছি আর কখনো কথাই বলব না, কখনো বা ভেবেছি শালা মজাতেই আছে অনেক বদলে গেছে আমার আর এখন দরকার নেই কিন্তু কেমন করে যেন আবার ঠিক হয়ে গেছে তা আর মনে নেই। মনে আছে সর্বোচ্চ এক মাস ওর সাথে কথা না বলে থেকেছিলাম কলেজে ক্লাস ৯ এ থাকার সময়। কেন লেগেছিলাম তাও মনে আছে কিন্তু এখানে লেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এত ছেলেমানুষ ছিলাম সেটা আমার আর ওর মাঝেই থাক। ১৩ বছর অল্প সময় না। তাই আজ বন্ধুদের নিয়ে কিছু লেখতে গিয়ে ওর নামই প্রথমে মনে পড়ল।
ভাল থাকিস দোস্ত।
Friday, April 24, 2009
ছোটদি (৪)
অনেক রাত এখন। হঠাৎ করে আজ এত ছোটদির কথা মনে পড়ছে তাই আপনার চিঠির উত্তর দিতে বসলাম। আপনার তো এখন খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। শরীরের যত্ন নিয়েন। নিজের জন্য না হোক আমার দিদিটার জন্য হলেও। আপনার জন্য সবসময় চিন্তা করত আমার দিদি এখনো নিশ্চয়ই করে।
স্কুল ফাইন্যালের পরপরই আমার বাবা মারা গেল। পরীক্ষা শেষ করে আমি তখন মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন রাত করে বাসায় ফিরতাম। দিদিরা ঝাড়ি দিত ঠিকই তবে তার মধ্যেও তেমন ঝাঁঝ ছিল না। মাঝে মাঝে বেশি দেরি হয়ে গেল শুধু ছোটদি বলত আমি প্রতিদিন তোর জন্য না খেয়ে বসে থাকি আর তোর টিকিটির কোন খবর থাকে না। তার কিছু আগেই হয়ত আমি পেট ভরে পুরি আর চা খেয়ে এসেছি। সেদিন এমনই আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় ঢুকার মুহূর্তে জটলা দেখে দাড়ালাম। ভেতর থেকে কে যেন বলছিল,” খোকনটা এখনো আসল না”। ভিড় ঠেলে নিজের বাসায় ঢুকলাম আমি যেখানে আমি খুব কমই পা ফেলি। দেখলাম বাবার খাটকে ঘিরে সবাই বসে আছে। বড়মা চোখ মুছছে। দিদিদের মুখ শক্ত হয়ে আছে। আমি আমার সবসময়ের নির্ভরতার প্রতীক ছোটদির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললাম, “কি হয়েছে দিদি?” সবাই ততক্ষণে আমাকে দেখতে পেয়েছে। ছোটদি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। বোকার মত আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম দিদি বাবা কই? হাউমাউ কান্নার ফাঁকে যা বুঝলাম বাবা আমার হঠাৎ করেই অফিসে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাবার এক কলিগ বাসায় নিয়ে আসেন। ওনার থেকে খবর পেয়ে যখন বড়মা দেখতে আসেন তখন আবার বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এরপর আর বেশি সময় কাউকে দেননি। কখন যে তার হার্ট এত দুর্বল হয়ে পড়েছে কেউ কবর রাখেনি। ছেলে হিসেবে কখনো তার কোন খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি সেদিন তাই খুব বাবাকে ডাকতে ইচ্ছে করছিল। বাবা নাকি শেষ সময়ে কাকে খুঁজছিলেন চারপাশে। সবাই বলছিল তোকেই খুঁজছিল খোকন। একটুও কাঁদিনি আমি তখন। বোকার মত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ছাদে উঠে বসেছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছিল। কেন যেন বাবা মারা যাওয়ায় আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল। এর আগে কখনো মনে পড়েনি। সেই চেহারা মনে করতে না পারা মহিলার কথা ভেবে দুচোখ দিয়ে পানি ঝরা শুরু করল। পেছন থেকে দিদিরা এসে আমার পাশে বসেছিল। কেউ স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। কাঁদতে দিয়েছিল আমাকে প্রাণ ভরে, সাথী হয়েছিল আমার কান্নার। ছোটদি আমাকে জাপটে ধরে মাথাটা আমার কাঁধে দিয়ে রেখেছিল।ওর চোখের পানিতে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। মেঝদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়েই বললাম, “ আমার মা বহুদিন একা ছিল দিদি, আজ অনেক খুশি হয়েছে তাইনারে দিদি? আমার তো তোমরা সবাই আছ আমার মার যে আর কেউ ছিল না ওখানে”।
বড়মা এসে দাঁড়িয়েছিল পিছনে। “খুব খারাপ লাগছে খোকা”?
প্রথম বারের মত হাউমাউ করে কাঁদলাম আমি। “ আমি কেন একা হব বড়মা। আমার কেন খারাপ লাগবে। মা বলতে তো সবসময় তোমাকেই ভেবেছি। কোনদিন তো মায়ের কথা মনে পড়েনি আজ কেন এত মনে পড়ছে। মায়ের কেন কোন চেহারা আমার একটুও মনে নেই। যতবার চেহারা খুঁজতে যাই তোমার চেহারা চলে আসে”। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম আমি।
গঙ্গার পানির কোন বিরাম নেই। এত রাতেও কলকাতার রাস্তায় হাজার মানুষের ভিড়ের একটুও কমতি নেই। শ্মশানের পাশে ঠিকই বসেছে জুয়া আর নেশার আড্ডা। শুধু নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে আমরা গুটিকয়েক প্রাণী বিধাতার হাতের পুতুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম। তাতে অবশ্য বিধাতার কিছু এসে যায় না। সে তার নিজের হিসাবে ঠিকই আবার ঘটায় একই ঘটনা।
বাবার মৃত্যুর পর আচার রীতি পালনের পর আমি বেশ কিছুদিন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা যেই রুমে থাকত সেখানে গিয়ে বসে থাকতাম একা একা। ছোটদি তখন নতুন চাকরী পেল। কলেজে পড়ানো শেষ করে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে আমার পাশে বসে থাকত। কখনো ওর কলেজের মজার মজার গল্প বলে আমার মন ভাল করার চেষ্টা করত। খেতে না চাইলে নিজ হাতে মুখে তুলে খাইয়ে দিত।আরো অনেক বেশি করে আদর পেতে থাকলাম ওর কাছ থেকে।
বেশিদিন থাকে নি আমার এই বৈরাগ্য ভাব। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে আমি দুরন্ত হয়ে উঠলাম। বহির্জগতের সাথে আমার পরিচয় ঘটল সর্বান্তকরণে। কিছু নতুন বন্ধুবান্ধব তাদের নিয়ে কফি হাউসে আড্ডা আমার নেশা হয়ে উঠল। শুরু হল আমার দেশোদ্ধারের চিন্তভাবনা। রক্তে যৌবনের গান শুনতে পেলাম আমি। পড়ালেখা নিয়ে পড়ে থাকার থেকে দেশ এর জন্য, অন্যায় এর প্রতিরোধের চিন্তা আমার রক্তে নাচন লাগাল। আমি রাজনীতিতে মেতে উঠলাম। পুরান বন্ধুরা বলত এইসব রাজনীতি হল এই বয়সের হিরোইজম। ওদের কথা তখন আমার গায়ে হূল ফুটাত। ওদের জন্য মায়া হত এখনো ঘরের ননীর পুতুল রয়ে গেল। ভর্তি ফি বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে এইসব নিয়ে নেতারা গরম গরম বক্তৃতা দিত আমাদের রক্ত টগবগ করে উঠত। মিছিল মিটিং শেষে নিজের হাতে পোষ্টার লেখতাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত। দেখতাম আমার ছোটদি একা জেগে আছে হয়ত কোন গল্পের বই পড়ছে। আমি আসারা সাথে সাথে খাবার টেবিলে খাবার গরম করে দিত। অপরাধীর মত ওর পাশে বসে পড়তাম খেতে। তখন শুরু হত ওর আমাকে বোঝানো পালা। একসময় ওর উপদেশের মুড শেষ হত। শুরু হত আমাদের ভাইবোনের গল্প।
আলাপে প্রায়ই আপনার কথা উঠে আসত। আপনার কথায় স্বপ্নীল হয়ে উঠত আমার দিদির মুখ। দিদিকে আপনি একটা শাড়ী দিয়েছিলেন। ও যেদিন সেটা পড়ে কলেজে যাচ্ছিল আমি আর মেঝদি ওকে খুব খেপাচ্ছিলাম। লজ্জায় আমার দিদি তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে বেঁচেছিল। এরপর প্রতিদিন দিদি কলেজে বের হওয়ার সময় আমরা ওকে জিজ্ঞেস করতাম কিরে তোর সাংবাদিকের শাড়ী পড়লি না যে। লজ্জা লাল হয়ে আমার দিদি বলত, “ মারব এক থাপ্পড়” । দিদির হাতে কখনো আমার থাপ্পড় খাওয়া হয়নি কিন্তু ও এত সুন্দর করে বলত মারব এক থাপ্পড়। প্রথম বেতন পেয়ে দিদি লিষ্ট করছিল কার জন্য কি কিনবে। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল পিচ্চি তোর কি লাগবেরে। কি সব বলেছিলাম মনে নেই কিন্তু যেদিন ও শপিং করে ফিরল তখন দেখি কাকে দিয়ে একটা সাইকেল নামাচ্ছে। বললাম কার জন্য এই সাইকেল । সেই কবে আমি কখন ওর কাছে সাইকেল চেয়েছিলাম ও নাকি বলেছিল চাকরী করে আমাকে সাইকেল কিনে দিবে আজ তাই আমার জন্য সাইকেল কিনে এনেছে। তখন বলেছিলাম তুই কিরে দিদি আমি এখন বড় হয়েছি না সাইকেল না কিনে আমাকে একটা বাইক কিনে দিতি। আজ ও সেই সাইকেল আমার রুমের পাশে থাকে। আমি চড়ি না তাতে কিন্তু প্রতি সপ্তাহে সেটাকে ধুয়ে মুছে চকচকে না করে রাখলে আমার শান্তি হয় না।
স্কুল ফাইন্যালের পরপরই আমার বাবা মারা গেল। পরীক্ষা শেষ করে আমি তখন মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিন রাত করে বাসায় ফিরতাম। দিদিরা ঝাড়ি দিত ঠিকই তবে তার মধ্যেও তেমন ঝাঁঝ ছিল না। মাঝে মাঝে বেশি দেরি হয়ে গেল শুধু ছোটদি বলত আমি প্রতিদিন তোর জন্য না খেয়ে বসে থাকি আর তোর টিকিটির কোন খবর থাকে না। তার কিছু আগেই হয়ত আমি পেট ভরে পুরি আর চা খেয়ে এসেছি। সেদিন এমনই আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় ঢুকার মুহূর্তে জটলা দেখে দাড়ালাম। ভেতর থেকে কে যেন বলছিল,” খোকনটা এখনো আসল না”। ভিড় ঠেলে নিজের বাসায় ঢুকলাম আমি যেখানে আমি খুব কমই পা ফেলি। দেখলাম বাবার খাটকে ঘিরে সবাই বসে আছে। বড়মা চোখ মুছছে। দিদিদের মুখ শক্ত হয়ে আছে। আমি আমার সবসময়ের নির্ভরতার প্রতীক ছোটদির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললাম, “কি হয়েছে দিদি?” সবাই ততক্ষণে আমাকে দেখতে পেয়েছে। ছোটদি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। বোকার মত আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম দিদি বাবা কই? হাউমাউ কান্নার ফাঁকে যা বুঝলাম বাবা আমার হঠাৎ করেই অফিসে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাবার এক কলিগ বাসায় নিয়ে আসেন। ওনার থেকে খবর পেয়ে যখন বড়মা দেখতে আসেন তখন আবার বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এরপর আর বেশি সময় কাউকে দেননি। কখন যে তার হার্ট এত দুর্বল হয়ে পড়েছে কেউ কবর রাখেনি। ছেলে হিসেবে কখনো তার কোন খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি সেদিন তাই খুব বাবাকে ডাকতে ইচ্ছে করছিল। বাবা নাকি শেষ সময়ে কাকে খুঁজছিলেন চারপাশে। সবাই বলছিল তোকেই খুঁজছিল খোকন। একটুও কাঁদিনি আমি তখন। বোকার মত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ছাদে উঠে বসেছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছিল। কেন যেন বাবা মারা যাওয়ায় আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল। এর আগে কখনো মনে পড়েনি। সেই চেহারা মনে করতে না পারা মহিলার কথা ভেবে দুচোখ দিয়ে পানি ঝরা শুরু করল। পেছন থেকে দিদিরা এসে আমার পাশে বসেছিল। কেউ স্বান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। কাঁদতে দিয়েছিল আমাকে প্রাণ ভরে, সাথী হয়েছিল আমার কান্নার। ছোটদি আমাকে জাপটে ধরে মাথাটা আমার কাঁধে দিয়ে রেখেছিল।ওর চোখের পানিতে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। মেঝদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়েই বললাম, “ আমার মা বহুদিন একা ছিল দিদি, আজ অনেক খুশি হয়েছে তাইনারে দিদি? আমার তো তোমরা সবাই আছ আমার মার যে আর কেউ ছিল না ওখানে”।
বড়মা এসে দাঁড়িয়েছিল পিছনে। “খুব খারাপ লাগছে খোকা”?
প্রথম বারের মত হাউমাউ করে কাঁদলাম আমি। “ আমি কেন একা হব বড়মা। আমার কেন খারাপ লাগবে। মা বলতে তো সবসময় তোমাকেই ভেবেছি। কোনদিন তো মায়ের কথা মনে পড়েনি আজ কেন এত মনে পড়ছে। মায়ের কেন কোন চেহারা আমার একটুও মনে নেই। যতবার চেহারা খুঁজতে যাই তোমার চেহারা চলে আসে”। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম আমি।
গঙ্গার পানির কোন বিরাম নেই। এত রাতেও কলকাতার রাস্তায় হাজার মানুষের ভিড়ের একটুও কমতি নেই। শ্মশানের পাশে ঠিকই বসেছে জুয়া আর নেশার আড্ডা। শুধু নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে আমরা গুটিকয়েক প্রাণী বিধাতার হাতের পুতুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম। তাতে অবশ্য বিধাতার কিছু এসে যায় না। সে তার নিজের হিসাবে ঠিকই আবার ঘটায় একই ঘটনা।
বাবার মৃত্যুর পর আচার রীতি পালনের পর আমি বেশ কিছুদিন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা যেই রুমে থাকত সেখানে গিয়ে বসে থাকতাম একা একা। ছোটদি তখন নতুন চাকরী পেল। কলেজে পড়ানো শেষ করে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে আমার পাশে বসে থাকত। কখনো ওর কলেজের মজার মজার গল্প বলে আমার মন ভাল করার চেষ্টা করত। খেতে না চাইলে নিজ হাতে মুখে তুলে খাইয়ে দিত।আরো অনেক বেশি করে আদর পেতে থাকলাম ওর কাছ থেকে।
বেশিদিন থাকে নি আমার এই বৈরাগ্য ভাব। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে আমি দুরন্ত হয়ে উঠলাম। বহির্জগতের সাথে আমার পরিচয় ঘটল সর্বান্তকরণে। কিছু নতুন বন্ধুবান্ধব তাদের নিয়ে কফি হাউসে আড্ডা আমার নেশা হয়ে উঠল। শুরু হল আমার দেশোদ্ধারের চিন্তভাবনা। রক্তে যৌবনের গান শুনতে পেলাম আমি। পড়ালেখা নিয়ে পড়ে থাকার থেকে দেশ এর জন্য, অন্যায় এর প্রতিরোধের চিন্তা আমার রক্তে নাচন লাগাল। আমি রাজনীতিতে মেতে উঠলাম। পুরান বন্ধুরা বলত এইসব রাজনীতি হল এই বয়সের হিরোইজম। ওদের কথা তখন আমার গায়ে হূল ফুটাত। ওদের জন্য মায়া হত এখনো ঘরের ননীর পুতুল রয়ে গেল। ভর্তি ফি বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে এইসব নিয়ে নেতারা গরম গরম বক্তৃতা দিত আমাদের রক্ত টগবগ করে উঠত। মিছিল মিটিং শেষে নিজের হাতে পোষ্টার লেখতাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত। দেখতাম আমার ছোটদি একা জেগে আছে হয়ত কোন গল্পের বই পড়ছে। আমি আসারা সাথে সাথে খাবার টেবিলে খাবার গরম করে দিত। অপরাধীর মত ওর পাশে বসে পড়তাম খেতে। তখন শুরু হত ওর আমাকে বোঝানো পালা। একসময় ওর উপদেশের মুড শেষ হত। শুরু হত আমাদের ভাইবোনের গল্প।
আলাপে প্রায়ই আপনার কথা উঠে আসত। আপনার কথায় স্বপ্নীল হয়ে উঠত আমার দিদির মুখ। দিদিকে আপনি একটা শাড়ী দিয়েছিলেন। ও যেদিন সেটা পড়ে কলেজে যাচ্ছিল আমি আর মেঝদি ওকে খুব খেপাচ্ছিলাম। লজ্জায় আমার দিদি তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে বেঁচেছিল। এরপর প্রতিদিন দিদি কলেজে বের হওয়ার সময় আমরা ওকে জিজ্ঞেস করতাম কিরে তোর সাংবাদিকের শাড়ী পড়লি না যে। লজ্জা লাল হয়ে আমার দিদি বলত, “ মারব এক থাপ্পড়” । দিদির হাতে কখনো আমার থাপ্পড় খাওয়া হয়নি কিন্তু ও এত সুন্দর করে বলত মারব এক থাপ্পড়। প্রথম বেতন পেয়ে দিদি লিষ্ট করছিল কার জন্য কি কিনবে। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল পিচ্চি তোর কি লাগবেরে। কি সব বলেছিলাম মনে নেই কিন্তু যেদিন ও শপিং করে ফিরল তখন দেখি কাকে দিয়ে একটা সাইকেল নামাচ্ছে। বললাম কার জন্য এই সাইকেল । সেই কবে আমি কখন ওর কাছে সাইকেল চেয়েছিলাম ও নাকি বলেছিল চাকরী করে আমাকে সাইকেল কিনে দিবে আজ তাই আমার জন্য সাইকেল কিনে এনেছে। তখন বলেছিলাম তুই কিরে দিদি আমি এখন বড় হয়েছি না সাইকেল না কিনে আমাকে একটা বাইক কিনে দিতি। আজ ও সেই সাইকেল আমার রুমের পাশে থাকে। আমি চড়ি না তাতে কিন্তু প্রতি সপ্তাহে সেটাকে ধুয়ে মুছে চকচকে না করে রাখলে আমার শান্তি হয় না।
বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়...
১
অনেক বছর হল, আর ২ মাস পার হলে ১২ বছর হবে। আব্বুকে নিয়ে কখনো কোথাও কিছু লেখা হয়নি। শেষ যখন আব্বুকে দেখেছি সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। অল্প একটু চেষ্টা করলেই দেখতে পাই ক্যাডেট ড্রেস পড়ে আমার ঘর থেকে মামার সাথে বের হয়ে যাওয়া দৃশ্য। আমার আব্বু বসে আছে বারান্দায়। আমি অনেকদুর এগিয়ে গিয়ে একবার দাঁড়িয়ে ছিলাম এরপর পিছনে তাকিয়েছিলাম। সেই দৃশ্য আমার চোখে ভাসে, আব্বু বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছে। তারপর আমি উঠে পড়েছিলাম রিকশায়। ক্লাস ৮ এ পড়ি তখন , জুনিয়র আসেনি তখনো। জুনিয়র আসার ৫ দিন আগে আবার যখন বাসায় এসেছিলাম তখন আর আব্বুকে পাইনি, সিলেট থেকে আমি আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল তার আগেই আব্বুর কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আব্বুর স্মৃতি স্মরণ করলে তাই আমার সেই চেয়ারে বসে থাকা দৃশ্যটা সবার আগে মনে পড়ে। আমাদের সেই বাসায় আমরা এখন আর থাকি না তবে সেই বাসার সেই বারান্দায় আমি আজো তাকাই সেদিক দিয়ে গেলেই।
বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়...
২
আমার আব্বু একেবারেই একজন পারিবারিক মানুষ ছিলেন। নিজের পরিবার ছাড়া তার কোন বড় আদর্শ ছিল না। আর ১০ জন সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীদের মতই তিনি সংসার চালাতেন আর মনে একটা বিশাল আশা নিয়ে রাখতেন তার ছেলেগুলা পড়ালেখায় অনেক বড় হবে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার আগে এবং বিকেলে বাসায় ফিরে সন্ধ্যার পর থেকে ৯ টা পর্যন্ত নিজেই আমাদের পড়াতেন। অঙ্ক আর ইংরজি ছাড়া আর কোন সাবজেক্ট তার কাছে পাত্তা পেত না। এই দুইটা পড়তে পড়তে জান কাহিল হয়ে যেত আমাদের। অন্য সাবজেক্টের হোমওয়ার্ক ও আমাদের অনেক কষ্ট করে করতে হত। তার কাছেই জেনেছিলাম আমাদের যেহেতু আর কিছু নেই এই পড়ালেখাই আমাদের একমাত্র পুঁজি। একে সম্বল করেই এগুতে হবে জীবনে উপরে উঠতে হলে। সবচেয়ে কষ্ট হত যেদিন এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিত। সবসময় বৃহস্পতিবারে রেজাল্ট দিত আর শুক্রবারে আব্বু বাজার থেকে পেপার কিনে আনত। সেটা পড়তে পড়তে আমাদের উপর চলত অবিরাম গালিগালাজ। আমরা কেন কিছু পারিনা এই দেখ কত ছেলেপিলে স্ট্যান্ড করে ফেলতেছে। তখন মনে মনে সেইসব স্ট্যান্ড করা ছেলেদের কত গালিগালাজ করেছি। নিজে করে দেখাব এইরকম ভাবার সাহস তখনো পাইনি কারণ স্ট্যান্ড করে তো টিভি, পেপারের ছেলেরা তারা কি মর্ত্যে বাস করে নাকি। আমার বাবাও কোনদিন মনে হয় এইরকম স্বপ্ন দেখেনি। কারণ আব্বু তখন তার অফিসে কলিগদের ছেলেরা স্টার মার্ক্স পেয়ে গোল্ড মেডেল পাচ্ছে এইসব গল্প শোনাত আমাদের। আমরাও সেটার আশা করতাম। স্টার মার্কস পাব গোল্ড মেডেল পেলে আব্বুর অফিসে বসরা বলবে, " জয়নাল সাহেবের ছেলেটা তো অনেক ব্রেইনি"। আমার আব্বু বিগলিত হাসি দিবে। এরচেয়ে অনেক বেশি আনন্দ দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ যখন আমাকে দিল তখন আব্বু এসবের অনেক ঊর্দ্ধে। ওপার থেকে কি এপারের কিছু দেখা যায়? আনন্দিত হবার ক্ষমতা কি থাকে? ২০০২ এর সেই দিন আমার খুব বলত ইচ্ছে করছিল , " আব্বু স্ট্যান্ড করা ছেলেদের শুধু যে পত্রিকার পাতায় দেখা যায় তাই না , আপনার ছেলের ছবি আজ পত্রিকার পাতায়"।
৩
ছোটবেলা থেকেই আমার ধারণা আমার আব্বু আমাকে কম আদর করে। এখনো এই ধারণা বদলায়নি। এরকম হতেই পারে এক ঘরে সব ছেলেকে সমান আদর করবে এরকম হয় না। আমিও অনেক ঘাউরামি করতাম। শুক্রবারের দুপুরের খাবারটাই শুধু সপ্তাহে একদিন আমরা আব্বুর সাথে খেতে পারতাম। সেদিন বাজার হত হয়ত মাছ কিনে আনা হত , সেটা থাকত আর আমার আব্বুর বাতিক হিসেবে একগাদা সবজি। সবজি আমি কোনকালের পছন্দ করতে পারি নি বিশেষ করে করলা। এই তিতা জিনিস মানুষ কেমন করে খায় আমি আজও বুঝিনা। আব্বুর সামনে খাওয়া তাই সবাইকেই ওটা খেতে হবে। কিন্তু আমি খাব না তাই প্রথমে ভাত নিয়েই অন্য তরকারী নিয়ে নিচ্ছিলাম। চোখে পড়ে গেলাম আব্বুর। কেন আমি সবজি খাব না সেই জন্য তখনই আমাকে কান ধরে ১০ বার উঠবস করতে বলল। রাগে অপমানে আমি সেদিন শুধু করলা দিয়েই ভাত খেয়েছিলাম। আমাদের বাসায় এখন আর করলা রান্না হয়না বুঝি যে তখন সবাই অনেক কষ্ট করে অপছন্দের খাবার খেত। এখনো কোথাও করলা দেখলে আমার চোখে সেই দিনের দৃশ্য ভেসে উঠে। মানুষের এই ফ্ল্যাশব্যাক সিস্টেম বড়ই অদ্ভুত অন্তত ১৫-১৬ বছর আগের ঘটনা এখনো চোখ বুঝলে সাথে সাথে চোখে ভেসে আসে।
৪
তখন ক্লাস ৫ এ পড়ি মনে হয় বন্ধুদের সাথে অন্য স্কুলের ছেলেদের সাথে ফুটবল ম্যাচ ফেলা হয়েছে। সকাল থেকে আম্মুকে ঘ্যানঘ্যান করছিলাম আব্বুকে বলার জন্য। আব্বুর কাছে সরাসরি আবদার জানাবার সাহস ছিল না আমার তার উপর শুক্রবার সারাদিন আব্বুর প্ল্যান থাকে আমাদের পড়াবার। অনেক কষ্টে আব্বুকে আম্মু রাজি করাল ১১টা পর্যন্ত মন দিয়ে পড়লে আমাকে খেলতে যাবার অনুমতি দেওয়া হবে। শুধু মন কেন আমি মন দেহ সব ঢেলে দিলাম পড়ায় ১১টা বাজার সাথে সাথে উঠে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম হঠাৎ আব্বুর কি মনে হল কি জানি বলল আমার খেলতে যাবার দরকার নেই। এ কথা শুনে তো আমার প্রাণ ফেটে যাচ্ছিল এই ভেবে যে তাহলে এতক্ষণ কষ্ট করে পড়লাম কেন। রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুর সাথে ঘ্যানঘ্যান করার শাস্তি পেয়েছিলাম সাথে সাথেই।
মনে হচ্ছে খুব কষ্টের স্মৃতি কিন্তু এখন ভাবতে ভাল লাগে। আমি সবার সাথে আমার আব্বুর কথা যখন বলি খুব সাধারণ ভাবেই বলি খারাপ ভাল রাগ একেবারে সাধারণ ভাবেই বলে যাই। আব্বু নেই দেখে কোন রকম আবেগ তুলে আনিনা তাই অনেকে ভাবে আব্বুর উপর আমার রাগ আছে। আসলে একেবারেই তা না। আব্বুর সাথে আমার বাপ-ছেলের সম্পর্কই ছিল। ছোট ছিলাম তাই শাসন খেয়েছি বড় হলে হয়ত সম্পর্কটা অনেক মধুর হত সেই সুযোগ পাইনি। আর আনন্দের স্মৃতি থেকে এইসব শাসনের স্মৃতিই বেশি মনে থাকে। কলেজে যাবার সুবাদে ৩ ভাইয়ের মধ্যে আমিই একমাত্র আব্বুর চিঠি পেয়েছিলাম। সব জমানো ছিল। প্রায় ১৭ খানা চিঠি যক্ষের ধনের মত জমিয়ে রেখেছিলাম। আমার বড় ভাই সেগুলা কোথায় যেন গুছিয়ে রাখল অনেকদিন দেখিনা। দেখি দেশে গেলে খুঁজে দেখতে হবে।
অনেক বছর হল, আর ২ মাস পার হলে ১২ বছর হবে। আব্বুকে নিয়ে কখনো কোথাও কিছু লেখা হয়নি। শেষ যখন আব্বুকে দেখেছি সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। অল্প একটু চেষ্টা করলেই দেখতে পাই ক্যাডেট ড্রেস পড়ে আমার ঘর থেকে মামার সাথে বের হয়ে যাওয়া দৃশ্য। আমার আব্বু বসে আছে বারান্দায়। আমি অনেকদুর এগিয়ে গিয়ে একবার দাঁড়িয়ে ছিলাম এরপর পিছনে তাকিয়েছিলাম। সেই দৃশ্য আমার চোখে ভাসে, আব্বু বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছে। তারপর আমি উঠে পড়েছিলাম রিকশায়। ক্লাস ৮ এ পড়ি তখন , জুনিয়র আসেনি তখনো। জুনিয়র আসার ৫ দিন আগে আবার যখন বাসায় এসেছিলাম তখন আর আব্বুকে পাইনি, সিলেট থেকে আমি আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল তার আগেই আব্বুর কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আব্বুর স্মৃতি স্মরণ করলে তাই আমার সেই চেয়ারে বসে থাকা দৃশ্যটা সবার আগে মনে পড়ে। আমাদের সেই বাসায় আমরা এখন আর থাকি না তবে সেই বাসার সেই বারান্দায় আমি আজো তাকাই সেদিক দিয়ে গেলেই।
বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়...
২
আমার আব্বু একেবারেই একজন পারিবারিক মানুষ ছিলেন। নিজের পরিবার ছাড়া তার কোন বড় আদর্শ ছিল না। আর ১০ জন সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীদের মতই তিনি সংসার চালাতেন আর মনে একটা বিশাল আশা নিয়ে রাখতেন তার ছেলেগুলা পড়ালেখায় অনেক বড় হবে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার আগে এবং বিকেলে বাসায় ফিরে সন্ধ্যার পর থেকে ৯ টা পর্যন্ত নিজেই আমাদের পড়াতেন। অঙ্ক আর ইংরজি ছাড়া আর কোন সাবজেক্ট তার কাছে পাত্তা পেত না। এই দুইটা পড়তে পড়তে জান কাহিল হয়ে যেত আমাদের। অন্য সাবজেক্টের হোমওয়ার্ক ও আমাদের অনেক কষ্ট করে করতে হত। তার কাছেই জেনেছিলাম আমাদের যেহেতু আর কিছু নেই এই পড়ালেখাই আমাদের একমাত্র পুঁজি। একে সম্বল করেই এগুতে হবে জীবনে উপরে উঠতে হলে। সবচেয়ে কষ্ট হত যেদিন এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিত। সবসময় বৃহস্পতিবারে রেজাল্ট দিত আর শুক্রবারে আব্বু বাজার থেকে পেপার কিনে আনত। সেটা পড়তে পড়তে আমাদের উপর চলত অবিরাম গালিগালাজ। আমরা কেন কিছু পারিনা এই দেখ কত ছেলেপিলে স্ট্যান্ড করে ফেলতেছে। তখন মনে মনে সেইসব স্ট্যান্ড করা ছেলেদের কত গালিগালাজ করেছি। নিজে করে দেখাব এইরকম ভাবার সাহস তখনো পাইনি কারণ স্ট্যান্ড করে তো টিভি, পেপারের ছেলেরা তারা কি মর্ত্যে বাস করে নাকি। আমার বাবাও কোনদিন মনে হয় এইরকম স্বপ্ন দেখেনি। কারণ আব্বু তখন তার অফিসে কলিগদের ছেলেরা স্টার মার্ক্স পেয়ে গোল্ড মেডেল পাচ্ছে এইসব গল্প শোনাত আমাদের। আমরাও সেটার আশা করতাম। স্টার মার্কস পাব গোল্ড মেডেল পেলে আব্বুর অফিসে বসরা বলবে, " জয়নাল সাহেবের ছেলেটা তো অনেক ব্রেইনি"। আমার আব্বু বিগলিত হাসি দিবে। এরচেয়ে অনেক বেশি আনন্দ দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ যখন আমাকে দিল তখন আব্বু এসবের অনেক ঊর্দ্ধে। ওপার থেকে কি এপারের কিছু দেখা যায়? আনন্দিত হবার ক্ষমতা কি থাকে? ২০০২ এর সেই দিন আমার খুব বলত ইচ্ছে করছিল , " আব্বু স্ট্যান্ড করা ছেলেদের শুধু যে পত্রিকার পাতায় দেখা যায় তাই না , আপনার ছেলের ছবি আজ পত্রিকার পাতায়"।
৩
ছোটবেলা থেকেই আমার ধারণা আমার আব্বু আমাকে কম আদর করে। এখনো এই ধারণা বদলায়নি। এরকম হতেই পারে এক ঘরে সব ছেলেকে সমান আদর করবে এরকম হয় না। আমিও অনেক ঘাউরামি করতাম। শুক্রবারের দুপুরের খাবারটাই শুধু সপ্তাহে একদিন আমরা আব্বুর সাথে খেতে পারতাম। সেদিন বাজার হত হয়ত মাছ কিনে আনা হত , সেটা থাকত আর আমার আব্বুর বাতিক হিসেবে একগাদা সবজি। সবজি আমি কোনকালের পছন্দ করতে পারি নি বিশেষ করে করলা। এই তিতা জিনিস মানুষ কেমন করে খায় আমি আজও বুঝিনা। আব্বুর সামনে খাওয়া তাই সবাইকেই ওটা খেতে হবে। কিন্তু আমি খাব না তাই প্রথমে ভাত নিয়েই অন্য তরকারী নিয়ে নিচ্ছিলাম। চোখে পড়ে গেলাম আব্বুর। কেন আমি সবজি খাব না সেই জন্য তখনই আমাকে কান ধরে ১০ বার উঠবস করতে বলল। রাগে অপমানে আমি সেদিন শুধু করলা দিয়েই ভাত খেয়েছিলাম। আমাদের বাসায় এখন আর করলা রান্না হয়না বুঝি যে তখন সবাই অনেক কষ্ট করে অপছন্দের খাবার খেত। এখনো কোথাও করলা দেখলে আমার চোখে সেই দিনের দৃশ্য ভেসে উঠে। মানুষের এই ফ্ল্যাশব্যাক সিস্টেম বড়ই অদ্ভুত অন্তত ১৫-১৬ বছর আগের ঘটনা এখনো চোখ বুঝলে সাথে সাথে চোখে ভেসে আসে।
৪
তখন ক্লাস ৫ এ পড়ি মনে হয় বন্ধুদের সাথে অন্য স্কুলের ছেলেদের সাথে ফুটবল ম্যাচ ফেলা হয়েছে। সকাল থেকে আম্মুকে ঘ্যানঘ্যান করছিলাম আব্বুকে বলার জন্য। আব্বুর কাছে সরাসরি আবদার জানাবার সাহস ছিল না আমার তার উপর শুক্রবার সারাদিন আব্বুর প্ল্যান থাকে আমাদের পড়াবার। অনেক কষ্টে আব্বুকে আম্মু রাজি করাল ১১টা পর্যন্ত মন দিয়ে পড়লে আমাকে খেলতে যাবার অনুমতি দেওয়া হবে। শুধু মন কেন আমি মন দেহ সব ঢেলে দিলাম পড়ায় ১১টা বাজার সাথে সাথে উঠে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম হঠাৎ আব্বুর কি মনে হল কি জানি বলল আমার খেলতে যাবার দরকার নেই। এ কথা শুনে তো আমার প্রাণ ফেটে যাচ্ছিল এই ভেবে যে তাহলে এতক্ষণ কষ্ট করে পড়লাম কেন। রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুর সাথে ঘ্যানঘ্যান করার শাস্তি পেয়েছিলাম সাথে সাথেই।
মনে হচ্ছে খুব কষ্টের স্মৃতি কিন্তু এখন ভাবতে ভাল লাগে। আমি সবার সাথে আমার আব্বুর কথা যখন বলি খুব সাধারণ ভাবেই বলি খারাপ ভাল রাগ একেবারে সাধারণ ভাবেই বলে যাই। আব্বু নেই দেখে কোন রকম আবেগ তুলে আনিনা তাই অনেকে ভাবে আব্বুর উপর আমার রাগ আছে। আসলে একেবারেই তা না। আব্বুর সাথে আমার বাপ-ছেলের সম্পর্কই ছিল। ছোট ছিলাম তাই শাসন খেয়েছি বড় হলে হয়ত সম্পর্কটা অনেক মধুর হত সেই সুযোগ পাইনি। আর আনন্দের স্মৃতি থেকে এইসব শাসনের স্মৃতিই বেশি মনে থাকে। কলেজে যাবার সুবাদে ৩ ভাইয়ের মধ্যে আমিই একমাত্র আব্বুর চিঠি পেয়েছিলাম। সব জমানো ছিল। প্রায় ১৭ খানা চিঠি যক্ষের ধনের মত জমিয়ে রেখেছিলাম। আমার বড় ভাই সেগুলা কোথায় যেন গুছিয়ে রাখল অনেকদিন দেখিনা। দেখি দেশে গেলে খুঁজে দেখতে হবে।
Subscribe to:
Posts (Atom)